বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দেশেই তৈরি হচ্ছে ফরমালিন

অনিয়ম তদন্তে শুল্ক গোয়েন্দারা

রুহুল আমিন রাসেল

পার্টিকেল বোর্ড তৈরির কাঁচামাল হিসেবে দেশে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে প্যারাফরমালডিহাইডের আমদানি। গত ৩ বছরে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া প্রায় ৩৮ হাজার টন প্যারাফরমালডিহাইডের বড় অংশ খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগ তদন্ত চলছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার সুপার বোর্ড মিল নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৬২৭ টন প্যারাফরমালডিহাইড খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এ প্যারাফরমালডিহাইডের সঙ্গে ৩৭ শতাংশ পানি মেশালেই তৈরি হয় জনস্বাস্থ্যের হুমকি ফরমালিন নামের বিষ। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন তৈরির উপাদান প্যারাফরমালডিহাইড খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ার সন্দেহ থেকেই তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে খোলাবাজারে বিক্রির প্রাথমিক সত্যতা উদঘাটন হয়েছে। বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত হওয়ায় প্যারাফরমালডিহাইডের অপব্যবহার নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। এফবিসিসিআইর সাবেক সহসভাপতি ও ফরমালিনবিরোধী জনসচেতনতায় সক্রিয় হেলাল উদ্দিন বলেন, দেশে ফরমালিন তৈরির সুযোগ আছে কিনা, আমি জানি না। তবে কেউ শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করে খোলাবাজারে বিক্রি করলে তার কঠোর শাস্তি সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। শুল্ক গোয়েন্দার তথ্যমতে, গত তিন বছরে ৩৭ হাজার ৯৪৩ টন প্যারাফরমালডিহাইড আমদানি করেছে শতাধিক কোম্পানি। আর এনবিআরের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর ১৭৬-১৮০টি প্রতিষ্ঠান ফরমালিন আমদানি করছে। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৫ হাজার ১৭৩ কেজি ফরমালিন আমদানি হয়েছে। আর আগের অর্থবছরে আমদানি করা হয় ২ লাখ ৫ হাজার ৯৭ কেজি। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৮৪৬ কেজি ফরমালিন আমদানি করা হয়েছিল। বর্তমানে ফরমালিন আমদানি বাড়তে শুরু করেছে। জানা গেছে, বৈধ পথে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার পর থেকে দেশে অবৈধভাবেই তৈরি হচ্ছে ফরমালিন। এমন প্রেক্ষাপটে আমদানি নিয়ন্ত্রিত প্যারাফরমালডিহাইড শুল্কমুক্ত সুবিধায় দেশে আনার পর তা খোলাবাজারে বিক্রির সত্যতা উদঘাটন করেছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। এ সংক্রান্ত একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন গত ৪ সেপ্টেম্বর এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের কাছে পাঠিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দার যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ সফিউর রহমান। এতে বলা হয়, মেসার্স সুপার বোর্ড মিলসের আমদানি করা ২০ কনটেইনার প্যারাফরমালডিহাইড খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরেই খালাস কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। এই অভিযোগ তদন্তে গঠিত শুল্ক গোয়েন্দা কমিটি সরেজমিন প্রতিষ্ঠানটির কারখানা পরিদর্শন করে ৬২৭ দশমিক ৭২ টন প্যারাফরমালডিহাইড খোলাবাজারে বিক্রির প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। ফলে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে সুপার বোর্ড মিলের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির তথ্য পাওয়া গেছে। এই প্যারাফরমালডিহাইডের সঙ্গে পানির নির্দিষ্ট অনুপাত মিশিয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ফরমালিন তৈরি করা সম্ভব। তাই যেসব আমদানিকারক প্যারাফরমালডিহাইড আমদানি করে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করে, সেসব প্রতিষ্ঠানে এই রাসায়নিক দ্রব্য সঠিকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে কিনা, তা যাচাই করতে একযোগে সারা দেশে তদন্ত করবে শুল্ক গোয়েন্দা। শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে সুপার বোর্ড মিলস পরিদর্শন করে বলেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত তিন বছরে ২০ হাজার ৬২ টন ৭৬৭ কেজি প্যারাফরমালডিহাইড আমদানি করলেও ব্যবহার করেছে ১৪ হাজার ৩৫ টন ৪০ কেজি। বাকি ৬২৭ টন ৭২৬ কেজি ব্যবহার না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এ বিষয়ে সুপার বোর্ড মিল বলেছে, ২০১৪ সালের ১৯ জুন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তাদের এক টন ৮০ হাজার কেজি প্যারাফরমালডিহাইড সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। তবে শুল্ক গোয়েন্দার তদন্ত দলের পর্যালোচনা হলো, ওই অগ্নিকাণ্ডে প্যারাফরমালডিহাইড ভস্মীভূত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদের মতে, ফরমালডিহাইড শরীরে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে লিভারে ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়ে মেটাবলিক এসিডোসিস উত্পন্ন করে। ফরমিক এসিড শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটানো ছাড়াও যকৃত ও কিডনি ধ্বংস করতে পারে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার যুগ্ম সম্পাদক ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ফরমালিন বা প্যারাফরমালডিহাইডের কাজ একই। প্যারাফরমালডিহাইড ক্যান্সারের মতো জীবনঘাতী রোগ ছড়িয়ে দেয়। এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচিত কঠোর নজরদারি ও আইনের প্রয়োগ। প্রয়োজনে ফরমালিন আইনের সংস্কার করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর