শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সোনালি আঁশের সোনালি স্বপ্ন

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

সোনালি আঁশের সোনালি স্বপ্ন

সোনালি আঁশে সোনালি স্বপ্ন দেখছেন রংপুরের পাটচাষি ও শিল্প উদ্যোক্তারা। সম্প্রতি বছরগুলোতে ভালো ফলন এবং পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় প্রতিবছর পাটের চাষ বাড়ছে। পাটজাত পণ্য উৎপাদনে গড়ে উঠেছে ১৫টি পাটকল। এসব পাটকলে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন মালিকরা। পাটকলগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ হাজার নারী-পুরুষের। দূর হয়েছে দারিদ্র্য, অসচ্ছলতা। আশির দশকের আগে ময়মনসিংহের পর দ্বিতীয় পাট উৎপাদনকারী জেলা ছিল রংপুর। পাট চাষ করে সে সময় কৃষকের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি দেশ কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত। কিন্তু প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পাট খাতে ধস নামতে শুরু করে। আশঙ্কাজনকহারে কমে যায় পাটের দাম। সোনালি আঁশ পাট কৃষকের গলার ফাঁসে পরিণত হয়। কৃষকরাও পাট চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। একপর্যায়ে পাট চাষ প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেয়। নিরুৎসাহিত কৃষককে পাটচাষে উৎসাহী করে তোলে। পাটচাষের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সরকারের সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপের ফলে পাট চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে চাষিরা। পাশাপাশি পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে খ্যাত পাট তার পুরনো কদর ফিরে পেয়েছে নতুন মাত্রায়। সংশ্লিষ্টরাও তাই সজাগ হয়েছে। বিমুখ কৃষকও ফিরে এসেছে পাটচাষে। চলতি বছর পাটের বাম্পার ফলন ঘটেছে। পাটের বাজারমূল্য বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের মুখেও ফুটে উঠেছে অমলিন হাসি। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম পাটের সর্বোচ্চ দাম উঠেছে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়ের হিসাবে চলতি বছর রংপুর বিভাগের আট জেলায় ৭৫ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে পাটচাষ করে ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৭৫ মেট্রিক টন পাট উৎপাদিত হয়েছে। গতবছর পাটচাষ হয়েছিল ৭২ হাজার ৩৫৪ হেক্টর জমিতে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের চূহড় গ্রামের কৃষক আবদুর রহিম বলেন, বোরো মৌসুমে এক একর জমিতে ধান চাষ করে আমার ১২ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। ওই জমিতেই এ বছর পাট চাষ করি। সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে ৩৬ হাজার টাকা। অপরদিকে দেশি-বিদেশি বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় উদ্যোক্তারাও পাটকল স্থাপনে ঝুঁকে পড়েছে। গত আট বছরে রংপুর বিভাগের আট জেলায় গড়ে উঠেছে ১৫টি পাটকল। আরও তিনটি পাটকল স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। এসব পাটকলে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির হার বাড়ছে প্রতিবছর। রংপুরের পীরগঞ্জে শাহ ইসমাইল গাজী (রহ.) জুট মিলসের মহাব্যবস্থাপক খায়রুল বাশার জানান, তাদের পাটকলে উৎপাদিত পাটের বস্তা ও সুতা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ভারত, চীন, হংকং, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করা হচ্ছে। গতবছর এসব দেশে ২০ হাজার মেট্রিক টন পাটের বস্তা ও সুতা (ইয়ার্ন) রপ্তানি করা হয়। চলতি বছর তার দেড়গুণের বেশি রপ্তানির ইচ্ছা আছে। এসব পণ্যের চাহিদা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

এই পাটকলে ৫০০ জন নারী-পুরুষ কাজ করছেন। এই পাটকলে দৈনিক ১৬ মেট্রিক টন পাটের চাহিদা। চাহিদার পুরোটাই রংপুর অঞ্চলের উৎপাদিত পাট দিয়ে মেটানো হচ্ছে বলে জানান তিনি। রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় মোতাহার হোসেন চৌধুরী জুট মিলসের নারী শ্রমিক আনোয়ারা বেগম (২৪) জানান, জুট মিল দেওয়ার পর নিয়োগ পাই। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে কাম করতে সমস্যা হয় না। দৈনিক ৪০০-৪৫০ টাকা আয় করি। স্বামীও তার সঙ্গে কাজ করেন। এখন তাদের সংসারে অভাব নেই। রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও নর্থ বেঙ্গল জুট মিলসের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, স্থানীয়ভাবে পটকল গড়ে ওঠায় কৃষকরা যেমন পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়ালে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য বিক্রি বাড়বে। এতে পাটকলগুলো লাভজনক হবে। উদ্যোক্তা বাড়বে। পাটের ভাগ্যাকাশে সম্ভাবনার যে সোনালি আলো দেখা দিয়েছে, তা যে কোনো মূল্যে ধরে রাখাই হবে কৃষি খাতে নয়া বিপ্লবের উৎস।

সর্বশেষ খবর