সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মহাসড়ক কেন মৃত্যুফাঁদ

বেপরোয়া গতি, অপ্রশিক্ষিত চালক ও বিপজ্জনক বাঁকের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

মহাসড়ক এখন যেন মৃত্যুফাঁদ। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কত পরিবারকে যে পথে বসতে হচ্ছে, কত পরিবার যে তাদের প্রিয় মানুষকে হারাচ্ছে, কিংবা কতজন কর্মক্ষম মানুষ তাদের অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন, এর কোনো ইয়ত্তা নেই। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের এমন কোনো স্তর নেই, যারা এ দুর্ঘটনার আওতা থেকে নিরাপদ। রাষ্ট্রের অনেক খ্যাতিমান ও বরেণ্য ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। তবে ঈদ মৌসুমে এ দুর্ঘটনার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। হালে এ মাত্রা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গেল ঈদের ছুটিতে ২১০টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬৫ জন নিরীহ মানুষ।

কিন্তু কেন এই সড়ক দুর্ঘটনা? মহাসড়কগুলো কেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে? এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দায়িত্ব যাদের, তারা সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করেন না। তাদের মতে, দিনের পর দিন বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা এবং নাগরিকদের চলাচল। সে অনুপাতে সড়কপথের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়নি। সড়ক নিরাপত্তাহীনতার জন্য সাধারণভাবে যানবাহনের বেপরোয়া গতি, লেন না মানা, অপ্রশিক্ষিত চালক, ত্রুটিযুক্ত যানবাহন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সড়কের বিপজ্জনক বাঁক বা খানাখন্দ দায়ী। যাত্রী নিয়ে রওনা হওয়ার আগে বাসের কল-কবজা পরীক্ষা এবং নির্ধারিত যাত্রীর চেয়ে বেশি না তোলার বিষয়টিও রয়ে গেছে অবহেলিত, যে কারণে মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) দুর্ঘটনা বাড়ার পাঁচটি কারণ দেখিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ঈদের সময় ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে দেশের সড়ক-মহাসড়কে। বেড়ে যায় গাড়ি চলাচল। ফলে বাড়ে দুর্ঘটনা।

পুলিশের হাইওয়ে রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি এম এ মালেক বলেন, ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বেশি ট্রিপ নেওয়া, চালকদের বিশ্রাম না নেওয়া, অপরিচিত রাস্তায় গাড়ি চালানো, অদক্ষ চালকসহ নানা কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তিনি বলেন, সড়কের দুর্ঘটনাকবলিত এলাকাগুলোতে মার্ক করা থাকলেও চালকরা তা লক্ষ করছেন না। লক্ষ করলেও তারা সেটি কেয়ার করছে না। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য এখন মামলা দেওয়া হচ্ছে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের পরিবারের কাছে গ্রামের বাড়িতে যান। আর অতিরিক্ত মানুষের চাপে মহাসড়কগুলোতে যান চলাচলও বেশি হয়, যা মহাসড়কে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। অন্যদিকে যানবাহনের মালিক ও সংশ্লিষ্টরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় নিয়ম ভঙ্গ করে ঈদের সময় মহাসড়কগুলোতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি নামান। অথচ এই দুর্ঘটনা রোধে সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থাপনা আমাদের নেই।’ তিনি বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের নিজ দায়িত্ব পালন না করে ঈদ উৎসব পালনে ব্যস্ত থাকেন। সে কারণে ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যাদের করা হয়, সেই চালকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, দুর্ঘটনার পেছনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন অন্যতম কারণ। আর এই অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে হয় মালিকদের চাপের কারণে। ঢাকা-দিনাজপুর রুটে ১০ বছর ধরে সাথী পরিবহনের ৪০ আসনের বাস চালকের দায়িত্ব পালন করছেন আবুল কালাম (৫৫)। তিনি বলেন, বাস মালিকরা অনেক সময় পর্যাপ্ত যাত্রী না পেলে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন মাঝপথ থেকে ৪০ জন যাত্রী নিয়ে নিতে। এতে করে যাত্রাপথে কালক্ষেপণ করতে হয়। আর এ কালক্ষেপণ অনেক সময় পুষিয়ে নিতে নির্ধারিত গতির চেয়ে দ্রুতগতিতে বাস চালাতে হয়। এ কারণে দুর্ঘটনায় পড়তে হয়। ট্রাকচালক আবুল কাশেম বলেন, মহাসড়কে পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত ট্রাক চালকরা বেশি আয়ের জন্য দ্রুতগতিতে ট্রাক চালিয়ে থাকেন। অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ হারানোয় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

সায়দাবাদ আন্তজেলা বাস শ্রমিক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আবু সুবা বলেন, ‘রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সব পক্ষই দায়ী। যদিও চালকদের দোষটা একটু বেশি থাকে। তবু আমি বলব এটা একটা আল্লাহর হুকুম। সবই তো আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। এসব দুর্ঘটনা রোধের জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। চালকদের সতর্কভাবে চালাতে বলছি। ওভারস্পিডে চালাতে বারবার নিষেধও করছি।’ ঢাকা-সিলেট বাস শ্রমিক কমিটির সেক্রেটারি মো. মিজান বলেন, দুর্ঘটনার জন্য চালকই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। দেখা গেছে একজন চালক ঢাকায় দুইবার আসা-যাওয়া করেন। এর মধ্যে তার কোনো বিশ্রাম থাকে না। আর চালক সংকট থাকলে গাড়ির মালিক তাকে আরেক ট্রিপ নিয়ে যেতে বলেন। এ সময় দেখা গেছে, ঘুম না পাড়ার কারণে তার চোখে ঘুম থাকে এবং মাথাও ঠিক থাকে না। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। অনেক সময় বিভিন্ন কারণে চালকের মনমানসিকতা খারাপ থাকে। আবার যখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয় কিংবা গাড়ি ওভারস্পিডে চালানো হয়, তখন বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএর এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, সরকার বিভিন্ন সময় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধে অভিযান চালিয়ে গাড়ি আটক করে। কিছুদিন পর এ গাড়িগুলো আবার রাস্তায় নামে। এসব গাড়ির মান এতটাই খারাপ যে হার্ড ব্রেকেও নির্দিষ্ট জায়গায় না থেমে অন্যত্র গিয়ে থামে। এ কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশে গাড়ির মালিকরা অনেক প্রভাবশালী। ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর তারা আবার সেসব গাড়ি ছাড় করিয়ে রাস্তায় নামান। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মতে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে প্রায় ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৬০৭ জনের অকালমৃত্যু হয়েছে। ২০১২ সালে ২ হাজার ৯ জন, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৫৪৬ জন, ২০১৪ সালে ২ হাজার ১৩৫ জন, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৫৮০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এসব দুর্ঘটনার ৪৪ শতাংশ ঘটে দুই বা ততোধিক যানবাহনের সংঘর্ষজনিত কারণে। এর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে প্রায় ১৭ ভাগ। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার জন্য মূলত দায়ী চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অদক্ষতা। এ ছাড়া সড়কের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনগুলোর মধ্যে ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশই যাত্রীবাহী বাস।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর