সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যে কারণে আগুনের সূত্রপাত

টাম্পাকো ট্র্যাজেডি

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও আফজাল হোসেন

গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় আগুনের মূল কারণ কী ছিল? কেন ঘটল ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ড? বয়লার বিস্ফোরণ, নাকি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ? নাকি অন্য কোনো কারণে ঘটেছে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা? এখন এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন আগুন নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

অগ্নিকাণ্ডের ১৫ দিন পেরোলেও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা শেষ হয়নি জেলা প্রশাসন, তিতাস, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসসহ আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সংশ্লিষ্টদের। কেউ বলছেন বয়লার বিস্ফোরণ, আবার কেউ বলছেন গ্যাস রাইজার বিস্ফোরণ। এমনকি গ্যাস লাইন থেকে অতিরিক্ত গ্যাস টেনে আনার মেশিন বুস্টার বিস্ফোরিত হয়ে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ। আর এই ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস দলের। ঘটনার তিন দিনের মাথায় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেনাবাহিনী যোগ দিলে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু বেশ কয়েকদিন ভিতর থেকে কালো ধোঁয়া বের হতেও দেখা যায়। তবে বয়লার পরিদর্শক বলছেন, কারখানার ভিতরে বয়লার রয়েছে সম্পূর্ণ অক্ষত। আবার গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছেন, গ্যাস লাইনও ছিল অক্ষত। এত বড় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের কারণ আসলে কোনটি? এ নিয়ে নানা রহস্য দেখা দিতে শুরু করেছে। ঘটনার দিন ওই কারখানায় কর্মরত বেশ কয়েকজন অগ্নি দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক বলছেন, গ্যাস লাইন বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এদিকে ঘটনার ১৫ দিন অতিবাহিত হলেও তিতাস ছাড়া আর কোনো তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। তিতাস গ্যাসের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনেও অগ্নিকাণ্ডের কারণ এবং আগুনের সূত্রপাতের সঠিক কোনো তথ্য নেই। তিতাস গ্যাস তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, গ্যাস রাইজার অক্ষত এবং গ্যাস থেকে আগুনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, ততই কারখানার আগুনের ঘটনার বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা জানান, টাম্পাকো কারখানার ভিতরে যেভাবে কেমিক্যাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, সে অবস্থায় যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের মারাত্মক ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে ঘটনার দিন কারখানার পাশের কোনো এক ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে তিনি ধারণা করেন। বয়লার পরিদর্শক (ঢাকা অঞ্চল) মো. সরাফত আলী বলেন, কারখানার দুটি বয়লারই অক্ষত রয়েছে। আমরা নিশ্চিত বয়লার বিস্ফোরণের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। অপরদিকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) বিপণন মহাব্যবস্থাপক রানা আকবর হায়দারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণত ইথাইল এসিড উন্মুক্তভাবে রাখার নিয়ম নাই। কিন্তু টাম্পাকো কারখানার ভিতরে দেখা গেছে মারাত্মক এসব ইথাইল এসিড ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থায় ছিল। তিনি অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, গ্যাসের কোনো কারণেই এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। প্রয়োজনে বুয়েটের প্রকৌশলী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পারেন। তিনি ধারণা করেন, কারখানার পাশের সোনালী ব্যাংকের পাশের দোতলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। দুর্ঘটনা শুরু হওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গ্যাস লাইন অক্ষত পেয়েছি। গ্যাস লাইনের ত্রুটির জন্য এ দুর্ঘটনা ঘটেনি। অপরদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, এ পর্যন্ত (রবিবার) ১০ হাজার ২১৬ টন ধ্বংসস্তূপ সরানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত ১ হাজার ২২টি ড্রাম উদ্ধার করা হয়েছে। যাতে কেমিক্যাল রয়েছে। তবে উদ্ধার কাজ শেষ হতে কতদিন লাগবে— তা এখনো বলা যাচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষ হলেই বলা যাবে আগুনের সূত্রপাতের কারণ। এই মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না। টাম্পাকো কারখানা লাগুয়া সোনালী ব্যাংকের আনসার সদস্য আবু তাহের ও সোহেল রানা বলেন, ঘটনার দিন ভোররাত সাড়ে ৪টার সময় আমরা নামাজ পড়ার জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠি। এরপর ভোর পৌনে ৬টা কিংবা তার একটু পরে একটি বিকট শব্দ হয়। এ সময় আমাদের ব্যাংক কেঁপে ওঠে, আমরা দৌড়ে বের হয়ে দেখি পাশের টাম্পাকো কারখানায় আগুন লেগেছে। পরে আমাদের ম্যানেজার খবর দিলে তারা অফিসে এসে আসবাবপত্র বের করে নেন। তারা আরও বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি কারখানার মূলফটকে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। গ্যাস রাইজার অথবা বুস্টার মেশিন বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের কাছে এর বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজও রয়েছে। এদিকে সেনাবাহিনী ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের এক কর্মকর্তা বলেন, সবাই বলে বয়লার বিস্ফোরণ হয়েছে। আসলে আমরা কারখানার ভিতরে তিনটি বয়লার পেয়েছি, একটি বড়, অপর দুটি ছোট। তিনটিই বয়লারই অক্ষত পেয়েছি। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের বিষয়টি এই মহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, গত শনিবার দুপুরে বর্জ্য সরানোর সময় ধ্বংসস্তূপের মাঝ এলাকা থেকে এক শ্রমিকের দেহাবশেষ উদ্ধারসহ এ পর্যন্ত ৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ওই দিন উদ্ধার হওয়া দেহাবশেষটি কার সেটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে দেহাবশেষটি প্রিন্টিং কর্মী আজিম উদ্দিন অথবা জহিরুল ইসলামের লাশ বলে কারখানার শ্রমিক জুলফিকার আলীর ধারণা। ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার করতে এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দল কারখানার ভিতরের অবস্থা দেখে চমকে ওঠেন। এ বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম মোহাম্মদ হাসান বলেন, টঙ্গীর টাম্পাকো কারখানার ঘটনা রানা প্লাজার চেয়েও ভয়াবহ। আমরা যা পেয়েছি তার মধ্যে কারখানার দুটি বয়লারই অক্ষত পাওয়া গেছে। এদিকে গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত টাম্পাকো কারখানার মূল ভবনের পূর্বপাশের অংশের ধ্বংসস্তুপ বেশিরভাগই সরিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের পূর্বপাশে থাকা সোনালী ব্যাংক ও জেলা বিসিক কার্যালয় ভবন সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। ধ্বংসস্তূপ থেকে কেমিক্যালের গন্ধ ও পোড়া গন্ধ বেড় হচ্ছে। আর এসব উৎকট গন্ধে ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জেলা বিসিক কার্যালয়ের ভিতরে থাকায় জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্রে দায়িত্বরত গাজীপুর জেলা প্রশাসকের প্রধান সহকারী এস এম সোলাইমান বলেন, ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনরা প্রতিনিয়ত তাদের স্বজনদের খোঁজে ভিড় করছেন।

 কিন্তু আমরা তাদের কী বলে সান্ত্বনা দেব সেই ভাষাটা জানা নেই। এ সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গুরুতর আহত অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ফকির শাহ আলমের ছোট ভাই হুমায়ুন কবীর জানান, আমার ভাই গুরুতর আহত হয়ে ১৫ দিন ধরে চিকিৎসাধীন। কিন্তু কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি আমার ভাইয়ের।

অবশেষে আজ আমি নিজেই এলাম কিছু সাহায্য পেতে। কিন্তু এখানে এসে দেখি আহতদের নামের তালিকায় আমার ভাইয়ের নামই লিপিবদ্ধ হয়নি। হুমায়ুন কবীর বলেন, অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ছুটে আসি কারখানায়। কিন্তু আমার ভাইকে কারখানায় না পেয়ে টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় পাই। কিন্তু আশঙ্কাজনক থাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওখানে তিন দিন থাকার পর কোনো ধরনের উন্নতি না হওয়ায় ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করি। এখনো পর্যন্ত আমার ভাই হাসপাতালের সিসিইউতে আছেন। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ১১ জনের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স কম। স্বল্প বয়সী এসব শ্রমিক কাজে অত্যন্ত উদ্যমী ছিল। এদের মধ্যে ফরিদপুরের বোয়ালমারীর বাহিরনগর এলাকার চুন্নু মোল্লা ছিল সবচেয়ে কম বয়সী এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সারগীত এলাকার মামুন ওরফে ক্লিনার মামুনেরও বয়স ছিল কম। গতকাল সন্ধ্যার দিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) এস এম আলম টাম্পাকো কারখানার ধ্বংসস্তূপের খোঁজখবর নিতে পরিদর্শনে আসেন। প্রসঙ্গত, ১০ সেপ্টেম্বর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের পর ভয়াবহ আগুন লেগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় টাম্পাকোর দুটি ভবন। এতে গতকাল পর্যন্ত মারা যান ৩৬ জন। ৩৬ জনের মধ্যে ২৯ জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও সাতজনের পরিচয় মেলেনি। অপরদিকে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১১ জন। নিহতদের মধ্যে একজন রিকশাচালক, দুজন পথচারী এবং পাশের বাড়ির একটি শিশুও রয়েছে। নিখোঁজ ১১ শ্রমিকের স্বজনেরা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। সিলেটের গোলাপগঞ্জের সৈয়দ মকবুল হোসেন ওরফে লেচু মিয়া ১৯৭৮ সালে টাম্পাকো ফয়েলস কারখানাটি চালু করেন। তিনি ১৯৮৬ ও ২০০১ সালে তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে তিনি বিএনপির লোক বলে পরিচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর