বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

খুন অন্য স্থানে, লাশ রেললাইনে

মাহবুব মমতাজী

খুন অন্য স্থানে, লাশ রেললাইনে

প্রতি বছর হাজারেরও বেশি মানুষের লাশ উদ্ধার করা হয় রেললাইন থেকে। যার বেশির ভাগ ট্রেনে কাটা কিংবা দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। আর সেগুলোর কোনো দায়দায়িত্ব না নিয়ে রেলওয়ে থানার খরচে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্য স্থানে খুনের ঘটনা ঘটে কিন্তু লাশ ফেলা হয় রেললাইনে। তবে কিছু ঘটনায় সন্দেহ হলে তা ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায় পুলিশ। তেমনই একটি ঘটনা, ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টলা ট্রেন থেকে পড়ে যাওয়া এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সন্দেহসাপেক্ষে ময়নাতদন্তের মাধ্যমে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য লাশ মর্গে পাঠানো হয়।

পরবর্তী সময়ে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা যায়, শ্বাসরোধে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। ওই বছরের ২৭ অক্টোবর পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করে। এর আগে এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলাও করা হয়েছিল। পুলিশের ভাষ্য, সব ঘটনায় তাত্ক্ষণিকভাবে অপমৃত্যু মামলা করা হয়। পুলিশ জানায়, যে লাশটি উদ্ধার করা হয় তার পরিচয় জানা যায়নি। সে কোথায় যাচ্ছিল, কার সঙ্গে যাচ্ছিল বা তার সঙ্গে কার বিরোধ ছিল, বিষয়গুলো সম্পর্কে পুলিশ কোনো তথ্যই উদ্ঘাটন করতে পারেনি। তাই ঘটনাটি রহস্যই থেকে যায়। যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ও প্রত্যক্ষদর্শী না পাওয়ায় এসব ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে পারে না পুলিশ। ফলে এসবের সুযোগ নিয়ে থাকে দুষ্কৃতকারীরা। আবার অনেক লাশের পরিচয় পেলেও ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া হিসেবে সেটিকে শুধু দুর্ঘটনা বলে ধরে নেওয়া হয়। এ কারণে রেলওয়ে থানায় বেশির ভাগই অপমৃত্যু মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়।

রেলওয়ে থানাসূত্র জানায়, ২০১৪ সালের একটি ঘটনায় কিছু চিত্র ফুটে ওঠে। আবু বকর গ্রামের বাড়ি যশোরে যাওয়ার সময় ওই বছরের ১৬ অক্টোবর ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চিত্রা ট্রেনের ছাদে ওঠেন। ট্রেনটি বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছলে সেখানে একই বগির ছাদে ওঠে পেশাদার ছিনতাইকারী মুন্না ও তার সহযোগী জুয়েল, মেহেদী, মিলন, রাসেলসহ আরও তিনজন। এ সময় তারা আবু বকরের মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আবু বকর মানিব্যাগ দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে জয়দেবপুরের ধীরাশ্রম রেলস্টেশনের কাছে ছাদ থেকে ফেলে দেয় তারা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় আবু বকরের। এ ঘটনার পর মৃত্যু নিয়ে পুলিশের সন্দেহ হলে তদন্ত শুরু হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুন্নাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মুন্না ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব ঘটনার বর্ণনা দেন। পরে ২৯ অক্টোবর পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করে। ওই বছর কমলাপুর রেলওয়ে থানা এলাকায় রেল দুর্ঘটনা ও হত্যা মিলিয়ে অক্টোবর পর্যন্ত নিহত হন অন্তত ১৭৫ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছিল পাঁচটি। চলতি বছরের জুনে জয়দেবপুর রেলস্টেশনের কাছে একটি লাশ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগেই ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হতে পারে মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয় জয়দেবপুর থানায়। তাকে অন্যত্র খুন করে রেললাইনে ফেলে রাখা হয় এমন তথ্য রেলওয়ে থানার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে কিছুদিনের মধ্যে। পরে নিহতের মা বাদী হয়ে রেলওয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। সর্বশেষ ১২ সেপ্টেম্বর বনানী রেলস্টেশনের পাশে আরও একজনের লাশ পায় পুলিশ। তা নিয়ে সন্দেহ হয় পুলিশের। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। তাত্ক্ষণিকভাবে সে ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা করেছে রেলওয়ে পুলিশ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলেই তা হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, ‘রেললাইনে যেসব লাশ পাওয়া যায় সবগুলোর ক্ষেত্রে আমরা প্রাথমিকভাবে অপমৃত্যু মামলা করি। পরে ময়নাতদন্তে যখন হত্যার আলামত পাওয়া যায় তখন সেগুলোকে হত্যা মামলায় রূপ দেওয়া হয়। এমন অসংখ্য ঘটনা আছে যে অন্য স্থানে হত্যার ঘটনা ঘটে, পরে লাশ রেললাইনে ফেলে রাখা হয়।’ রেলওয়ে থানার পরিসর সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসি বলেন, কমলাপুর থেকে যমুনা সেতুর আগ পর্যন্ত রেললাইনের দুই পাশের ১০, ১০ করে মোট ২০ ফুট জায়গা রেলওয়ে থানার অধীনে। এখানে যা কিছু ঘটবে বা পাওয়া যাবে সবই এ থানার ওপর দায় বর্তাবে। থানার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জয়দেবপুরে শালবনের মধ্যে অনেক নির্জন স্থান রয়েছে, যেখানে সচরাচর কোনো মানুষের চলাচল থাকে না। সেসব স্থানে অনেক সময় মানুষ খুন করে রেললাইনে ফেলে রাখা হয়। শুধু জয়দেবপুরেই নয়, বাংলাদেশে এমন অনেক স্থানেই নিয়মিত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। যেসব এলাকায় ট্রেন চলাচল আছে, সেখানে অপরাধীরা এ সুযোগ নিচ্ছে। পরে দেখা যায় উদ্ধার লাশের পরিচয় পাওয়া যায় না কিংবা তদন্ত করেও বের করা হয় না। ময়নাতদন্ত শেষে রেলওয়ে থানার খরচে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। সূত্র জানায়, ১৮৬১ সালের রেলওয়ে আইনের ১২ নম্বর ধারার ঘ উপধারা অনুযায়ী ট্রেনে কাটা লাশ ধর্ম ও জাতীয়তা অনুসারে দাফন বা দাহ্য করার জন্য ৮ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমানে একটি লাশ উদ্ধার করলে ১ হাজার ৪০০ টাকা ডোমদের দিতে হয়। আর যে পুলিশ কর্মকর্তা ওই মামলা পরিচালনা করেন, তাকে দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। লাশ উদ্ধার করে মর্গ পর্যন্ত পৌঁছাতে যানবাহন খরচের জন্য আরও প্রায় ৪-৫ হাজার টাকা লাগে। কখনো আবার দূরত্ব বুঝে যানবাহন খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। সব মিলিয়ে একেকটি লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো পর্যন্ত গড়ে অন্তত সাড়ে ৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, প্রতি বছর রেললাইনে দুর্ঘটনা, ট্রেনে কাটা পড়া ও আত্মহত্যার ঘটনায় ২ হাজারেরও বেশি লোকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তবে ট্রেন দুর্ঘটনা ছাড়া যে কোনো লোক ট্রেনে কাটা বা ধাক্কায় মারা গেলে তার দায়দায়িত্ব রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের থাকে না। ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর আইনের ১২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোকবিহীন কোনো সাধারণ মানুষ কিংবা গবাদিপশু প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। এ এলাকায় সব সময়ই ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভিতর কাউকে পাওয়া গেলে ওই আইনের ১০১ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে। গবাদিপশু আটক করে তা বিক্রির টাকাও সরকারের কোষাগারে জমা করার বিধান রয়েছে।

সর্বশেষ খবর