শিরোনাম
শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জাতীয় পরিচয়পত্রে ভয়ঙ্কর জালিয়াতি

একজনের ছবি আঙুলের ছাপ, বাকি সব তথ্য অন্যের

সাখাওয়াত কাওসার

জাতীয় পরিচয়পত্রে ভয়ঙ্কর জালিয়াতি

কেবল ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ একজনের। বাকি সব তথ্য অন্যের। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ফাঁকি দিতে নিজের বাবা-মার পরিচয় গোপন করে অন্যের বাবা-মার নাম, ঠিকানা ও অন্য সব তথ্য ব্যবহার করেছিলেন জাহিদুর রহমান (৩৬) নামের এক মানব পাচারকারী। বাগিয়ে নিয়েছিলেন একটি জাতীয় পরিচয়পত্র। নির্বাচন কমিশন সার্ভারে ১৯৭৯৪৭৯২১০১০০০০০৩ নম্বর কিংবা তার আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে সার্চ দিলেই চলে আসছে এই পরিচয়পত্রের যাবতীয় তথ্য। ২০১০ সালের ১০ মে ইস্যু হওয়া এই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মানব পাচারকারী জাহিদুর তৈরি করেছিলেন পাসপোর্ট। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৪ মে তিনি মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) বানিয়ে নেন। পাসপোর্ট নম্বর-বিবি ০০৫৫৯৭১। সম্প্রতি র‌্যাবের একটি অভিযানে জাতীয় পরিচয়পত্রের এমন জালিয়াতির ঘটনার সন্ধান পাওয়ার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের চোখ রীতিমতো কপালে উঠেছে। এমন আরও ঘটনা আড়ালে রয়েছে কি না তা ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, মানব পাচারের মতো অপরাধে জড়িত থাকার তথ্যে ২৯ আগস্ট জাহিদুর রহমান নামের ওই ব্যক্তিকে আটক করে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের সন্ধান পায় র‌্যাব-৩-এর সহকারী পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল। পরে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের আদালত প্রতারক জাহিদুর রহমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। বর্তমানে কারাবন্দী ভয়ঙ্কর এই প্রতারকের অপকর্মের সন্ধান করেছেন এই প্রতিবেদক। যদিও ভুক্তভোগী, অর্থাৎ যার তথ্য ব্যবহার করে প্রতারক জাহিদ জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়েছেন, গতকাল পর্যন্ত তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে জাহিদুর জাতীয় পরিচয়পত্র একবার সংশোধন করেছেন এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি ছোটখাটো কোনো অপরাধ নয়। ছয় বছর আগে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছিলেন জাহিদুর। অবশ্যই ওই   প্রতারকের বড় কোনো পরিকল্পনা ছিল। তাই তার কাছ থেকে ওই সব তথ্য আদায় করা উচিত। এ ধরনের ঘটনা দেশে আরও ঘটেছে কি না নির্বাচন কমিশনের উচিত তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা। তবে এ ধরনের কাজ নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের যোগসাজশেই হয়েছে বলে মন্তব্য তাদের। তবে দায়সারা বক্তব্য পাওয়া গেছে নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। কমিশনের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ রকম কোনো ঘটনা সম্পর্কে প্রশাসন যদি আমাদের জানায় কিংবা এ ঘটনায় মামলা হয়, তবে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাহিদুর রহমানের প্রকৃত বাবার নাম সারোয়ার হোসেন। মা সেলিনা বেগম। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে তিনি বাবা হিসেবে আবদুল ওহাব এবং মা হিসেবে হামিদা বেগমের নাম ব্যবহার করেছেন। ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করেছেন খুলনা সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত উপজেলা দৌলতপুর। পোস্ট : অফিস কুয়েট। গ্রাম : মহেশ্বরপাশা, কেদারনাথ রোড। ভোটার এলাকা : কেদারনাথ রোড। ওয়ার্ড নম্বর-১। এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে এরই মধ্যে জাহিদুর রহমান সফর করেছেন চীন, নেপাল, মালয়েশিয়াসহ একাধিক দেশ। জাহিদুর রহমান নামেই দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারের ব্যবসা করে আসছিলেন তিনি। ওই প্রতারক এর বাইরে আরও কতসংখ্যক অপরাধ করেছেন এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত খুব একটা তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি গোয়েন্দারা। ৩৭ বছরের জাহিদুর রহমান এরই মধ্যে দুটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রী রিতু খুলনা কাশীপুরের বাসিন্দা। আড়াই বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন তার প্রকৃত বাবা সারোয়ার হোসেন। এর কিছুদিন পরই তিনি আবার বিয়ে করেন খালিশপুর মুজদুন্ডির হোসেন আলীর মেয়ে রুমানাকে। দৌলতপুরের পালপাড়া রেলগেট এলাকায় প্রতারক জাহিদুরের পরিবারের অন্য সদস্যরা বসবাস করেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, এ ধরনের অপরাধে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতিবাজ সদস্যদের যোগসাজশ রয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে কি না কর্তৃপক্ষের উচিত তা গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। র‌্যাব-৩ অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সারোয়ার বলেন, অভিবাসন আইন ভঙ্গ করে কিছুসংখ্যক নারীকে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে ১০ ফকিরাপুলের মডেল এভিয়েশনে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকেই আটক করা হয় জাহিদুর রহমানসহ তিনজনকে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দারুস সালাম এলাকার সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার থেকে ২৬ জন নারীকে উদ্ধার করা হয়। যদিও সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার ভাড়া দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। তিনি আরও বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে প্রতারক জাহিদের কাছ থেকে উদ্ধার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আমাদের সন্দেহ হয়। পরে ভয়ঙ্কর এ প্রতারণার বিষয়টি বেরিয়ে আসে।’

যেভাবে অপরাধের সন্ধান : নিজের নামে কোনো লাইসেন্স না থাকলেও জাহিদ মতিঝিল এলাকার ১০ ফকিরাপুলের মডেল এভিয়েশন সার্ভিসেসের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালদের মাধ্যমে সহজ-সরল নারীদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে লিবিয়া, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করে আসছেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩-এর এএসপি আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল এই সিন্ডিকেটের নানা অপকর্মের বিষয়ে তথ্য পায়। এ তথ্যের ভিত্তিতে ফকিরাপুলের মডেল এভিয়েশনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে জাহিদুরসহ তিনজনকে আটক করে র‌্যাব। বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে জাহিদুর রহমানের বাবা সারোয়ার হোসেন এবং স্ত্রী রুমানার সঙ্গে কথা বলেন র‌্যাব সদস্যরা। সর্বশেষ জাহিদুরের সঙ্গে থাকা পরিচয়পত্রে বাবার নাম আবদুল ওহাব দেখার পরই সন্দেহ দানা বাঁধে র‌্যাব সদস্যদের। এবার জিজ্ঞাসাবাদ শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে। একপর্যায়ে জাহিদ স্বীকার করেন তার অপকর্মের কথা। তবে প্রকৃত জাহিদুর রহমানের ঠিকানা কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্যের নাম আদায় করতে পারেনি র‌্যাব। এদিকে জাহিদুরের জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়ে প্রকৃত জাহিদুর রহমানের কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকজন এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ২০ বছর আগে আবদুল ওহাব নামের এক লোক তার পরিবার নিয়ে ওই এলাকায় কিছুদিন ভাড়াটে ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে এ প্রতিবেদক দেখা করেন প্রতারক জাহিদের বাবা সারোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি খুলনা দৌলতপুরের একটি জুট মিলের সিকিউরিটি গার্ড। সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি বাবা অল্প লেখাপড়া করিছি। আমার ছেলির সঙ্গে বিএল কলেজে পড়ত আরেক জাহিদ। একদিন তার সঙ্গি আমার বিএল কলেজের সামনে দেখা হয়িছিল। তাদের বাড়ি ফরিদপুরে তখন এইটা আমি শুনিছিলাম। তার বাবার নাম আবদুল ওহাব এটাও আমার মনে আছে। এর বাইরে আমি কিছু বলতে পারব না।’ খুলনার নির্বাচন কমিশন অফিস সূত্র বলছে, ২০১০ সালে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ১ নম্বর ওয়ার্ডের কেদারনাথ রোডের মহেশ্বরপাশার ভোটারদের শনাক্ত করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনিই এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। তবে এ ব্যাপারে খুলনা বিভাগীয় নির্বাচন কমিশনের সার্ভার ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়টি ভালো জানবেন শনাক্তকারী ব্যক্তি। অথবা অসৎ উপায়ে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েই জাহিদুর তথ্য বিকৃত করিয়েছেন।

সরকারি কোয়ার্টারে নারী : রাজধানীর দারুস সালামে সড়ক ও জনপথ স্টাফ কোয়ার্টারে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ভুক্তভোগী নারীদের মগজ ধোলাই করতেন জাহিদুর রহমান ও তার সঙ্গীরা। ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করতেন তারা। ভুক্তভোগী নারীদের কুয়েত কিংবা সৌদি আরবের বিভিন্ন কোম্পানিতে আকর্ষণীয় বেতনের প্রলোভন দেখানো হতো। তবে তাদের পাচার করা হতো মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের বিভিন্ন পতিতালয়ে। সর্বশেষ ২৯ জুলাই সড়ক ও জনপথের ৩৩/ডি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে ২৬ জন নারীকে উদ্ধার করে র‌্যাব। ওই ফ্ল্যাটটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের ক্লার্ক আবুল কাশেমের নামে বরাদ্দ হলেও তিনি তা ভাড়া দিয়েছিলেন মুন্নী বেগম নামের এক মহিলাকে।

সর্বশেষ খবর