শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অনিরাপদ চিকিৎসা পণ্যের ঝুঁকিতে মানুষ

মাহবুব মমতাজী

দেশের বিভিন্ন বাজারে জীবন সুরক্ষার জন্য রোগ প্রতিরোধে ব্যবহূত অনিরাপদ চিকিৎসা-সামগ্রীর ছড়াছড়ি ঘটছে। এসবের নেই কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নিবন্ধনের ব্যবস্থা। তবু ওষুধ প্রশাসন এসব যন্ত্রপাতি ও সামগ্রী পরীক্ষার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। ফলে চরম ঝুঁকিতে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করছে চিকিৎসাসেবা। জীবন রক্ষায় ব্যবহূত গ্লাভস, সুই, সিরিঞ্জ, ইনজেকশন, সুতার ব্যবহার করা হচ্ছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। বেশির ভাগ মেডিকেল ডিভাইস বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও এর মান সম্পর্কে কিছুই জানে না কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনায় দেশের দুস্থ রোগীদের জীবন দিন দিন হুমকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনিরাপদ চিকিৎসা-সামগ্রী মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ব্যবহারের ফলে ঘটতে পারে অসুস্থতা, ক্ষত, এমনকি মৃত্যু। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনসহ আরও কিছু বিদ্যুিনর্ভর যন্ত্রপাতি আছে, যেগুলোর মান সম্পর্কে বোঝার কোনো উপায় থাকে না। কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই কোনো ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও নেই কোনো আইন। সুবিধাভোগী চিকিৎসকরাও অসৎ উদ্দেশ্যে ভালো মানের কথা বলে মানহীন সামগ্রী রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করে থাকেন। চরম এই ঝুঁকিতেও দেশে এসব যন্ত্রপাতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মান নিয়ন্ত্রণ ও যাচাইয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা সামগ্রীগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।

তাদের মতে, একজন রোগী প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসার সময় নির্ভর থাকেন একজন চিকিৎসকের ওপর। যখন ইনজেকশনের সুই কিংবা সুতা ব্যবহার করা হয়, তখন কর্তৃপক্ষও জানে না সেগুলো ভালো, না খারাপ। এর পরও সেগুলো রোগ নির্ণয়, রোগ প্রতিরোধ, পর্যবেক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ সারাতে হামেশা ব্যবহার করা হচ্ছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু দিকনির্দেশনা গ্রহণ করেছে, যেখানে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় চিকিৎসার ব্যবহূত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেশে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানি করার ক্ষেত্রে। কিন্তু আমদানিকারক ও উৎপাদকরা দেশে ব্যবহূত প্রায় ১৮০০ চিকিৎসা-সামগ্রীর মধ্যে প্রায় ১০০টি পণ্যের নিবন্ধন করিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, বাজারে যেসব চিকিৎসা-সামগ্রী বা পণ্য পাওয়া যায় সে সম্পর্কে যে কোনো রোগীর পক্ষে এর মান যাচাই করা সম্ভব হয় না। কারণ সেসব ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রমাণপত্র রাখা হয় না। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন অপারেশনের রোগীরা।

২০১৫ সালের একটি স্বাস্থ্য বুলেটিন সূত্রে জানা গেছে, ২ হাজার ৫১৪ জন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট থেকে হার্ট অপারেশন করিয়েছেন। আর ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩.৭২ লাখ নারী প্রসবের সময় সিজার করিয়েছেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফ বলেন, ‘প্রতিটি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহূত পণ্যে আমাদের দেশে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। এতে অনেক ঝুঁকি থাকে। অপারেশনের পর রোগীদের তা থেকে ইনফেকশন হতে পারে। অপারেশনের পর অনেকের দেখা গেছে তাদের সুস্থ হতে সময় লাগে। মূলত এসব কারণেই। আর এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের যথেষ্ট গাফিলতি এবং জ্ঞানের ঘাটতি আছে। চিকিৎসা-সামগ্রীর মান নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাদের কোনো বিশেষজ্ঞ নেই।’ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর জানায়, দেশে প্রতি বছর ১৮ হাজার কোটি টাকার চিকিৎসা-সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্তত ১০০টি সামগ্রীর নিবন্ধন করা হয়েছে। সেগুলো নিবন্ধনে করা হয়নি যথাযথ পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘বাংলাদেশে মেডিকেল ডিভাইস বা পণ্যসামগ্রীর কোনো মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। এতে ঝুঁকি নিশ্চিতভাবে বিরাজ করে। এসব জিনিসের মান সাধারণের পক্ষে কোনোভাবে বোঝার উপায় নেই। মান নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে। এটা করতে পারে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সঙ্গে বিএসটিআই। ড্রাগের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। কিন্তু ডিভাইসগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের কোনো আইন নেই। ফলে যে কোনো দুর্ঘটনার দুর্নাম ডাক্তারকেই নিতে হয়। এসব মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পেশাজীবী সংগঠনগুলো সরকারের কাছে পদক্ষেপ চাইতে পারে। অন্তত জনদুর্ভোগ কমাতে এবং নিজেদের দুর্নাম ঘোচাতে চিকিৎসকদের তত্পর হওয়া দরকার বলেও জানান তিনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা মেডিকেলের কোনো ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করি না। এগুলো বিএমএ ভবন থেকে করা হয়। আমরা শুধু গবেষণার কাজে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি সরবরাহ করি, যেগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ বিএসটিআই থেকে করা হয়।’বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ অস্বীকার করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সুপারিনটেনডেন্ট রাজিবুল হাবীব বলেন, ‘কিছু জিনিস আছে যেগুলোকে আমরা ওষুধ হিসেবেই গণ্য করি। ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু গাইডলাইন করা হয়েছে, যেখানে অনুমোদিত কোম্পানিগুলো মেডিকেল ডিভাইসের স্যাম্পল আমাদের ল্যাবে মান নিয়ন্ত্রণের পর বাজারজাত করে থাকে। আমাদের দুটি ল্যাব আছে। একটি ঢাকার মহাখালীতে আর অন্যটি চট্টগ্রামে। বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে মানুষের জন্য ৭টি ও ভেটেরিনারি ওষুধের ক্ষেত্রে ১৪টি দেশের অনুমোদন আছে।’ এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর