রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বন্দরে ভয়াবহ নাশকতার আশঙ্কা

সর্বোচ্চ সতর্কতার নির্দেশ, তিন গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্দরে ভয়াবহ নাশকতার আশঙ্কা

দেশে এবার রাষ্ট্রবিরোধীদের নাশকতার নয়া টার্গেটে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউস। মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দুই প্রতিষ্ঠানে ভয়াবহ নাশকতার আশঙ্কা করেছেন গোয়েন্দারা। এর নেপথ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কর্মচারী নামের শতাধিক সিন্ডিকেট। এই প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কবলে জিম্মি চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এমন তথ্য পেয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রের।  সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউস সম্পর্কে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থার একজন পরিচালকের স্বাক্ষর করা গোপনীয় প্রতিবেদন গত ৬ সেপ্টেম্বর আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খানের কাছে। ওই প্রতিবেদনের অনুলিপি দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানকে।

গোয়েন্দা সংস্থাটির ওই গোপনীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের রাজস্ব আদায়ের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে সক্রিয় একটি চক্র রাষ্ট্রবিরোধী নাশকতা করে বন্দর অচল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এর পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের দালাল নামধারী ৭০ থেকে ৮০ জনের সিন্ডিকেট চক্র। এই চক্র বন্দরে কাস্টমস হাউসের ভিতরে এতটাই প্রভাবশালী যে—তাদের ছাড়া কাস্টমসের কোনো কাজই হয় না। এমনকি কাস্টমসের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের কম্পিটারের পাসওয়ার্ড থাকে কথিত এই ফালতুদের হাতে। অর্থাৎ এই ফালতুরা চাইলে যে কোনো সময়ে ওই কাস্টমস হাউসের গুরুত্বপূর্ণ নথি ও তথ্যাদি চুরি বা গায়েব করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, এই চক্রের সদস্যরা নিয়মিত যাতায়াত করেন বন্দরের ভিতরে। সেখানে প্রবেশ করে বিভিন্ন কন্টেইনারে কেবল নজরদারিই নয়, কখনো কখনো কন্টেইনারসমূহ খুলে থাকে এই দালালরা। এদের কর্মকন্ডাকের কারছে চট্টগ্রাম বন্দর বছরে ৫০ শতাংশ রাজস্ব হারাচ্ছে। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এদের এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রাম বন্দরে রাষ্ট্রবিরোধী নাশকতাও হতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ধরনের ক্ষেত্রে যদি কোনো সংবাদ পাই, এটা যেহেতু সংবেদনশীল একটা বিষয়, তখন আমাদের মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে করণীয় থাকে—আইজিকে (পুলিশের মহাপরিদর্শক) এবং অন্যান্য সংস্থা যারা আছে, তাদের সবাইকে বলা, সব দিক থেকে সতর্ক থাকা। এবং সেই ব্যাপারে যত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা লাগে, সেটা নেওয়া। এর বেশি আমার আর স্পষ্ট কোনো মন্তব্য নেই। আমি তো ওই চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি, পুলিশের কাছে। এই চিঠি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব পুলিশের। এখন পুলিশ বলতে পারবে, তারা কী করেছে।’  এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে থাকা বহিরাগতদের আর ভেতরে রাখতে চাই না। এ জন্য এনবিআর একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করেছে। এনবিআরের একজন সদস্যের নেতৃত্বের এই কমিটি একটি নীতিমালা তৈরি করবেন। আমাদের তিন গোয়েন্দা প্রধান ওই কমিটিতে আছেন। নীতিমালা তৈরি হলে, এটা ঠিক হয়ে যাবে। এ সম্পর্কিত আরেকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন গত ২৯ সেপ্টেম্বর এনবিআরে প্রেরণ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। মূলত এসব গোয়েন্দা প্রতিবেদন পেয়েই এনবিআর সদস্য খন্দকার আমিনুর রহমানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে থাকা এনবিআরের তিন গোয়েন্দা প্রধান হলেন— কর গোয়েন্দা সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স সেল—সিআইসি’র মহাপরিচালক বেলাল উদ্দিন, শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান ও ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মাসুদুল কবীর। শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান স্বাক্ষরিত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়— চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে দীর্ঘদিন যাবৎ ‘ফালতু’ হিসেবে শতাধিক বহিরাগত কাজ করছে। এদের একটি তালিকাও আছে। এরা অতীতে কোনো কর্তাব্যক্তি বা প্রভাবশালী ব্যক্তির আশ্রয়ে নিয়োগ পেয়েছে এবং বর্তমানে এদের অংশ কাস্টমস হাউসের শুল্কায়ন ও নানা দাফতরিক কাজে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। এ সব ‘ফালতু’ ব্যক্তি কাস্টমস কর্মকর্তাদের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করাসহ নধিপত্রাদির রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। ফলে সরকারি দফতরের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৪ সালের ৭ জুলাই টিআইবি প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনেও এই ফালতুদের নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। অপরদিকে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ—টিআইবি বিগত ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই প্রকাশিত ‘চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় অটোমেশন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে তখন বলেছিল— চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে প্রতিদিন গড়ে ন্যূনতম সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা নিয়ম-বহির্ভূতভাবে লেনদেন হয়। এই ঘুষের অর্থ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাগজপত্র সঠিক থাকলেও নগদ উেকাচ হিসেবে কাস্টমস সংশ্লিষ্টদের বাধ্যতামূলকভাবেই দিতে হয়। এই অনৈতিক সমঝোতার ক্ষেত্রে দালাল হিসেবে কাজ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে অবৈধভাবে কর্মরত কিছু ‘ফালতু’ বা ‘বদি আলম’ নামে পরিচিত শুল্ক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সহায়তাকারী। এ অবস্থায় কাস্টমসের অনিয়ম ও অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর