রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজশাহীতে দারোগার চাঁদা দাবির অডিও ফাঁস

দিনভর তোলপাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহী মহানগর পুলিশে (আরএমপি) এক ‘চাঁদাবাজ’ দারোগার সন্ধান পাওয়া গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে উপ-পরিদর্শক (এসআই) উত্তম কুমার নগরীর বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার ও মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন। নগরীর মাহফুজুল আলম সুজন (৪০) নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতে গিয়ে এমন তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। চাঁদার দাবিতে সুজনের সঙ্গে দারোগা উত্তমের বেশ কয়েকবার মোবাইলে কথাবার্তা হয়। ওসব কথাবার্তার কয়েকটি অডিও ক্লিপ বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে এসেছে। অডিও ক্লিপ থেকে জানা যায়, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার নামে এসআই উত্তম ব্যবসায়ী সুজনের কাছে ৫০ হাজার টাকা চান। শুধু তাই নয়, সুজনের বাড়িতে অভিযানে যাওয়ার দিন নিচতলার এক বাসিন্দার মোবাইল ফোন নিয়ে আসারও প্রমাণ মিলেছে ওই অডিও ক্লিপে। নগরীর হেতেম খাঁ এলাকার বাসিন্দা সুজন জানান, দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে থেকে বছর খানেক আগে তিনি দেশে ফেরেন। এরপর ঢাকায় একটি ব্যবসা করছেন। ঈদে বাড়িতে এসেছেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে সাদা পোশাকে উত্তমসহ দুজন পুলিশ পরিচয়ে তার বাসায় আসেন। বাসায় তারা তল্লাশি চালান। কিছু না পেয়েও তাকে থানায় নিতে চান। বলেন, ‘ডিসি স্যারের নির্দেশ আছে।’ সুজন জানতে চান, কোন অভিযোগে তাকে থানায় নেওয়া হবে? একপর্যায়ে রাজন নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ডেকে আটকের হাত থেকে রক্ষা পান সুজন। তবে এসআই উত্তম যাওয়ার সময় হাতের পাঁচ আঙ্গুল দেখিয়ে বলেন, ‘নিয়ে আসেন, আমি বিষয়টি মীমাংসা করে দেব। তা না হলে আপনাকে আটক করে মামলা দেওয়া হবে। তখন ঝামেলায় পড়বেন।’

এরপর এসআই উত্তমের সঙ্গে সুজনের কয়েক দফা ওই টাকা প্রসঙ্গে মোবাইলে কথা হয়। সংলাপটি তুলে ধরা হলো—

সুজন—ভাই কেমন করে এইটা থেকে পার পাব? কিছু করলাম না, জানলাম না, শুনলাম না...।

উত্তম—আমি যেমন ভালো, তেমনই খারাপ। গোটা থানা এলাকায় শুনে দেইখেন।

—আপনি লাস্ট পর্যন্ত কী বললেন বুঝলাম না। মানে আমার তো ম্যানেজ করতে হবে, তাই না?

—আপনারে সাক্ষাতে বলবনি।

—সাক্ষাতে...কখন সাক্ষাৎ করব বলেন।

—বাইরে যে কোনো জায়গায় ডাইকেন, আমি চলে আসব।

এর একদিন পর সুজন এসআই উত্তমকে ফোন করে বলেন, ‘ভাই, ভয় পাইতাসে, যাইতে দিতাছে না কোনো দিকে।

—জি?

—ওই ওয়াইফ। ভয় পাইতাছে। বলছে, যাওয়ার দরকার নাই কোনো দিকে। আপনি আসেন না...।

—আরে যাবনি, আমি একটু ডিসি স্যারের কাছে আছি। কালকে যাবনি।

—কালকে আসবেন...। কাল একটু ঢাকা যাইতাম...।

—দেখা করার কী দরকার আছে? যেটা বলছি, ওটা ইয়া করেন।

— দশ?

—না ভাই। বললাম না পাঁচ?

—আপনি তো পাঁচ আঙ্গুল দেখাইলেন। এখন কিছু করলাম না, জানলাম না। কেমনে কী! পঞ্চাশ কী সম্ভব? এ তো অসম্ভব ব্যাপার।

—কিছুই না। মনে করলেই হবে। আমি আপনার সমন্ধে সবই জানি, বোঝেন নাই? ভাই আমি একটা কথা বলি, আমি এ টু জেড সব জানি।

—যদি জানেন, তাইলে কিন্তু অনেস্ট, আপনি অনেস্ট হইয়া কথা বলেন। আপনি সততা বজায় রাখেন। আপনি তো জানেনই আমি এসবের ভিতরে না।

—তাহলে আমার জায়গায় আমি।

—ভাই ওই আরেকটা জিনিস। নিচের মহিলাটা খুব জ্বালাইতাছে, বিরক্ত করতাছে। ভাই আপনেরা নাকি, সাজুর কাছেও (ওই নারীর ছেলে) ২০ চাইছেন? আর মোবাইল নাকি নিয়া চলে গেছেন।

—ওগলা সব মিথ্যা। মহিলা খুব খারাপ। মোবাইল ধুইয়া পানি খাব নাকি? মহিলা তো খারাপ, বোঝেন নাই? ওর হাতে মোবাইল দিয়া আসলাম। আবার বলে যে...।

—আমি বললাম, আপনের ছেলে গেট খুলছে তাই মোবাইল নিয়ে চলে যাবে! আমারে বিরক্ত করতাছে ভাই।

—বেশি বিরক্ত করলে আপনি আমারে জানাবেন।

এর পরের কথোপকথনে সাজুর মাকে ২০ হাজার টাকা দিতে বলার জন্য সুজনকেই চাপ দেন এসআই উত্তম।

বলেন— ভাই আপনি ওকে বলবেন, আপনি কখন দিছেন? বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি ওর গুষ্টিসহ তুলে নিয়ে আসব, বোঝেন নাই? মহিলা তো আসলে বেয়াদব মহিলা। আচ্ছা বাদ দেন। আর আপনারে যেইটা বলছি, আমি স্যারকে ওইটাই বলছি।

—এইটা সম্ভব না তো। একটা সময় থাকে না মানুষের? এমনি জুলুমে পইড়া গেছি।

— আচ্ছা আপনের যেইটা ভালো হয়, আপনি আমারে জানাইয়েন। আর যদি আসতে বলেন, তাহলে আমি আসব। আচ্ছা কবে দেখা করবেন? একবারই দেখা কইরেন, হ্যাঁ?

—আচ্ছা চেষ্টা কইরা দেখি, কত কী করতে পারি।

—ঠিক আছে তাহলেই হবে।

এর পরদিন সুজন এসআই উত্তমকে ফোন করেন। এই কথোপকথনটিও তুলে ধরা হলো—

—নমস্কার উত্তম দা। ওই ডিসি সাহেবের কথা বললেন তো, আমি বিশের মতো কালকে দিতে চাই আপনেরে। যে কোনো একটাভাবে কইরা দিমু, হ্যাঁ?

— না ভাই, আমি তো স্যারকে চল্লিশের কথা বইলা আসছি, বোঝেন নাই?

— ওইটা সম্ভব! এখন সম্ভব না। ভাই, জুলুম হইয়া যায়।

—ভাই, আপনি আমার ভাই, বোঝেন নাই?

—শুধু শুধু একটা টাকা দিতে খুবই খারাপ লাগে, বোঝেন তো।

— তো আপনি বলতেন, শুধু শুধু দিব না। এইভাবে নিয়া যান।

—ভাই, আপনি আমার ভাই। সম্মান রক্ষা করার মালিক আল্লাহ। একবারের নাশতার বিল আপনার।

— আপনি যেভাবে আল্লাহ বললেন, তাতে তো ইমান আইসা পড়ে, সত্য কথা। ভালো লাগল।

—হ্যাঁ। আপনার একবারের নাশতার বিল। আমি তো সব জানি, বোঝেন নাই? ভাই সম্মান রাখার মালিক আল্লাহ। সম্মান গেলে সম্মান পাওয়া যায় না। একটা কথা বললাম।

—তাইলে কালকে বিকেল পর্যন্ত সময় দেন। আমি দেখি। সময় সব সময় এক রকম থাকে না।

—ঠিক আছে ভাই, সমস্যা নাই। আমি তো আপনার ভাই।

—আবার ডিসি সাহেবের কথা কইসেন তো, কী জড়ায় দিছেন!

—স্যারেক দেয়া লাগবে তো, ওই জন্য।

এসআই উত্তম কুমার সুজনকে ফোন করার কথা স্বীকার করলেও চাঁদা দাবির কথা অস্বীকার করেন। এরপর এ নিয়ে সংবাদ না লেখার অনুরোধ জানান।

নগরীর বোয়ালিয়া থানা এলাকাটি আরএমপির পশ্চিম জোনে। এ অঞ্চলের উপ-কমিশনার (ডিসি) এ কে এম নাহিদুল ইসলাম। উত্তম কুমার তার নামেই ব্যবসায়ী সুজনের কাছে চাঁদা দাবি করেছিলেন। এ নিয়ে জানতে চাইলে ডিসি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এর সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমার নাম ভাঙিয়ে চাঁদা দাবি করে এসআই উত্তম চাকরি হারানোর মতো অপরাধ করেছেন। ভুক্তভোগী আরএমপিতে লিখিত অভিযোগ দিলে উত্তমের চাকরি থাকবে না।’

সর্বশেষ খবর