বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জীবন সায়াহ্নে ৭৬ হাজার শিক্ষকের আহাজারি

বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ

আকতারুজ্জামান

সারা জীবন শিক্ষকতা করে অবসর গ্রহণের পর জীবন সায়াহ্নে এসে প্রায় ৭৬ হাজার শিক্ষক আহাজারি করছেন কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার অর্থ না পেয়ে। শিক্ষকদের এমপিওর (মান্থলি পে অর্ডার) ২ শতাংশ অর্থ কেটে রাখা হয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলে। আর ৪ শতাংশ কেটে রাখা হয় অবসর সুবিধা বোর্ড তহবিলে। মাসিক বেতনের অংশ থেকে কেটে রাখা অর্থ এই খাতে জমা রাখলেও চাকরি শেষে তা পাওয়ার জন্য পোহাতে হচ্ছে অশেষ ভোগান্তি। বার্ধক্যে উপনীত শিক্ষকরা জীবনের শেষ সময়গুলোয় একটু ভালো থাকতে, সুস্থ থাকতে এই টাকার জন্য রাজধানীর নীলক্ষেতে ব্যানবেইস ভবনে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এদের কেউ রোগাক্রান্ত। অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতেও পারছেন না। শিক্ষকদের অনেকেই মারা গেছেন অবসর ভাতার অর্থ হাতে না পেয়েই। এ অর্থের জন্য আবেদন করলেও তাদের অর্থ ছাড় হচ্ছে চার থেকে ছয় বছর পর। গতকাল ব্যানবেইস ভবনে গিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের করুণ দৃশ্য দেখা গেছে। জানা গেছে, কল্যাণ ট্রাস্টে ৩১ হাজারের বেশি শিক্ষকের অর্থপ্রাপ্তি পেন্ডিং অবস্থায় রয়েছে। আর অবসর সুবিধা বোর্ডে টাকা পেতে বিলম্বের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ৪৫ হাজারের বেশি শিক্ষককে। শিক্ষকরা বলছেন, কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ে অবসর সুবিধা বোর্ডের অর্থপ্রাপ্তিতেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বেশি। অবসর ভাতার জন্য ২০১২ সালে চাকরি শেষে আবেদন করেন শাহ মো. মোজাম্মেল হক। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে সাতগিরি দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। অবসরে যাওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পরও এই অর্থ না পেয়ে গতকাল রংপুর থেকে ব্যানবেইস কার্যালয়ে খোঁজ নিতে এসেছিলেন তার পুত্র হামিদুল হক। হামিদুল জানান, তার বাবা মোজাম্মেল হক এখন প্যারালাইজড। চলাফেরা করতে পারেন না। পাঁচ সদস্যের পরিবার চলছে টানাপড়েনে। বাবার ওষুধপথ্য কিনতেই অনেক টাকা বেরিয়ে যায়। অভাবের এই সময় বাবার অবসর ভাতার টাকাটা হাতে পেলে একটু স্বস্তি আসত। কিন্তু আবেদনের পর প্রায় পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও অবসর ভাতা পাওয়ার নাম নেই। ৩৭ বছর শিক্ষকতা করার পর ২০১২ সালে অবসরে যান মো. আবদুল মোতালেব (৭৮)। তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশালে বাগান ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার অর্থ চেয়ে আবেদন করলেও অবসর ভাতার কোনো অর্থই পাননি। কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থ পেয়েছেন দুই ধাপে। বার বার এখানে ধরনা দিয়ে কোনো আশ্বাসই পাচ্ছেন না। শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার পর আবেদন করলে তাদের চার-পাঁচ বছর পর খোঁজ নিতে বলা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কার্যালয় থেকে। কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার টাকা চেয়ে আবেদন করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেলিম আজহারুল ইসলাম ঠাকুর। তিনি সরাইল পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। অবসর সুবিধা বোর্ডে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর তাকে ২০২১ সালে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। শেষ জীবনে এসে শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার ভাতা দ্রুত না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, শিক্ষকদের চাঁদার টাকায় কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে সে হিসেবে প্রায় ১৭ কোটি টাকা তহবিলে জমা হয়। কিন্তু নতুন স্কেল ঘোষিত হওয়ায় এ খাতে প্রতি মাসে আমাদের প্রয়োজন ৬০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের শেষ কয়েক মাসে আবেদন করা শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা এখন দেওয়া হচ্ছে।

সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে সম্প্রতি ৫০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দিয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষকদের চাঁদার পরিমাণ ২ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে উন্নীত করার কথা ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটি বাস্তবায়ন হলে আর প্রতি বছর বাজেটে সরকার কিছু থোক বরাদ্দ দিলে আশা করছি শিক্ষকরা আবেদন করলে তিন মাসের মধ্যেই তাদের অর্থ ছাড় করতে পারব। অবসর সুবিধা বোর্ডের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মো. জামাল হোসাইন বলেন, শিক্ষকদের বেতনের ৪ শতাংশ কেটে এ তহবিল গঠিত হয়েছে। সম্প্রতি সরকার অবসর সুবিধা বোর্ড তহবিলে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ ও ৫০০ কোটি টাকা সিড মানি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ অর্থপ্রাপ্তি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সরকার শিক্ষকদের বেতনের ৪ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ কেটে এ খাতে রাখার পরিকল্পনা করেছে। সরকারের অর্থপ্রাপ্তির পর হয়তো শিক্ষকদের অবসর সুবিধার অর্থ পেতে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।

সর্বশেষ খবর