রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নির্বাচন কমিশনের হাল ধরছেন কে

সার্চ কমিটিতে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি রাখার পরামর্শ

গোলাম রাব্বানী

নির্বাচন কমিশনের হাল ধরছেন কে

‘নতুন কে আসছে হাল ধরবার জন্য’— এই কৌতূহল মেটাতে সবার চোখ এখন নির্বাচন কমিশনের দিকে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের বিদায়ের পর আসবে নতুন নির্বাচন কমিশন। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কমিশনে যারা আসছেন কীভাবে তাদের নিয়োগ হবে, আগামী নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে সবখানেই চলছে জল্পনা। সুশীল সমাজ-রাজনীতিবিদসহ সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে এখন একই আলোচনা। এমনকি নবম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপিও নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে সরব। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি তুলেছে তারা। ইসি নিয়োগের ‘সার্চ কমিটি’ গঠনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর দাবিও জানিয়েছে দলটি।

এদিকে স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী একটি আইন তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। আর আইনে সার্চ কমিটিসহ নিয়োগের অন্যান্য বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছেন অনেকে। এ ছাড়া সার্চ কমিটিতে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ইসি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত করলে নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক কমে যাবে। এমনকি নতুন কমিশনে একজন নারী সদস্য রাখার কথাও বলেছেন তারা।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও গত চার দশকেরও বেশি সময়ে তা আর হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিধান রাখার প্রস্তাবও এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরিতে নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেই ২০১২ সালে ৫ সদস্যের বর্তমান ইসি গঠন হয়। কিন্তু ইসি নিয়োগে কোনো আইন  না হলেও গেলবারের মতো দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ‘সার্চ কমিটি’র মাধ্যমে নতুন ইসি আসছে। যাদের অধীনে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮। ১[(১) এ বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া] বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ এ অবস্থায় পরবর্তী কমিশন গঠনের আগে আইন প্রণয়ন হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে গতবারের মতো এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি নিয়োগের আভাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী। আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারও আগের প্রক্রিয়ায় ইসি নিয়োগ হবে। ২০১২ সালে যেভাবে বর্তমান ইসি গঠন করা হয়েছিল, এবারও সেভাবেই হবে। তারা বলেছেন, সংবিধানের আলোকে ইসি নিয়োগে আইন করার পরিকল্পনা সরকারের নেই। রাষ্ট্রপতি যথাসময়ে সংবিধান অনুসারে ইসি নিয়োগ দেবেন। এ নিয়ে এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি ‘ইলেকশন কমিশনার : মেথড অব রিক্রুটমেন্ট’ নামে একটি খসড়াও তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছিল। সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতি সব সময় সিইসি ও ইসি নিয়োগ দিলেও সর্বশেষ পাঁচ সদস্যের কমিশন হয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে। সে সময় প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি গঠনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন পরিচালনা করবে সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। সেই নির্বাচন কমিশন গঠন করতে আপনাদের নির্বাচিত সার্চ কমিটি নয়, জনগণের নির্বাচিত সার্চ কমিটি দ্বারা। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। অন্যথায় যে উদ্যোগই গ্রহণ করেন না কেন— জনগণ তা সমর্থন করবে না।

স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ইসি নিয়োগের জন্য এখনো অনেক সময় আছে। ইসি নিয়োগের জন্য একটি আইন প্রয়োজন। সংবিধানে আইনের বিষয়ে বলা থাকলেও কেন তা হচ্ছে না। আইন না করে অন্য কোনো ভাবে ইসি নিয়োগ হলে সংবিধান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি বলেন, একটি আইন হলে তার মধ্যে সব থাকতে পারে। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। এ জন্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের একান্ত প্রয়োজন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সার্চ কমিটিতে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি রাখা দরকার। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ জোটের প্রতিনিধি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও সার্চ কমিটিতে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের একজন করে প্রতিনিধি করার কথাও বলেন তিনি। এবারে ইসিতে একজন নারী সদস্য নিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সবার অংশগ্রহণে ইসি গঠিন হলে তা নিয়ে বির্তক কম হবে।

বিগত সার্চ কমিটি ও সংলাপ : ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নামের সুপারিশ তৈরি করতে চার সদস্যের সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারককে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য হন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশন চেয়ারম্যান। এর আগে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অধিকাংশ দলই সার্চ কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল। ইসি গঠন নিয়ে ২২ ডিসেম্বর থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ২৩টি দলের মতামত নেন রাষ্ট্রপতি। এ সংলাপে অধিকাংশ দলই সংবিধান অনুসারে সিইসি ও ইসি নিয়োগে আলাদা আইন করা বা অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে মত দেয়। সার্চ কমিটির আহ্বানে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল নতুন কমিশনের জন্য তাদের পছন্দের ব্যক্তির নামের তালিকা দিলেও বিএনপি কোনো নাম দেয়নি। এই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ জমা দেয়, তাতে সিইসি ও চার কমিশনার নিয়ে পাঁচ পদের জন্য ১০টি নাম আসে। তার মধ্য থেকেই পাঁচজনকে বেছে নেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির আদেশের পর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পর দিন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়েই তারা যোগ দেন ইসিতে। ২০১১ সালের ২৯ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন হয়। এতে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অনধিক চার নির্বাচন কমিশনার নিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের বিধানযুক্ত হয়। দেশের একাদশতম সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন নেতৃত্বাধীন ইসির মেয়াদ শেষে ফেব্রুয়ারিতে আসবে নতুন ইসি।

সর্বশেষ খবর