শিরোনাম
সোমবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ উপেক্ষা

অবাধে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ

আহমদ সেলিম রেজা ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ মানছে না অনেক কোম্পানি। দেশের ২২টি ওষুধ কোম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোসপেরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করা হলেও তারা উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। বাজার থেকে মানহীন ওষুধ প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশও মানছে না তারা। সরকারের কাগজপত্রে এসব কারখানা বন্ধ দেখানো হলেও ওইসব কারখানাতে ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন চলছে। একইসঙ্গে বিদেশে ওষুধ রপ্তানির দোহাই দিয়ে তারা ওষুধ প্রশাসনসহ বিভিন্ন দফতরে তদবিরে নেমেছে উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ প্রত্যাহারের জন্য। ফলে রাজধানীসহ দেশব্যাপী অবাধে বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিক্যান্সারের ভেজাল ওষুধ।

সংসদীয় কমিটির কার্যপত্র থেকে জানা যায়, আদালতের নির্দেশে ও সংসদীয় কমিটির সুপারিশ মোতাবেক ২০ ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া বাজার থেকে তাদের ভেজাল ওষুধ প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন। একইসঙ্গে ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের অপরাধে ১৬টি কোম্পানির কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। ৭টি ওষুধ কোম্পানির সব ধরনের ওষুধ তৈরির লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত হলেও আদালতের রায়ে ৫টির লাইসেন্স বাতিল করা যায়নি। জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি গঠিত বিশেষজ্ঞ তদন্ত দলের প্রতিবেদনে ৮৪টি ভেজাল ওষুধ কোম্পানিকে শনাক্ত করে সংসদীয় কমিটির কাছে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুপারিশ করেছিল। পরে সংসদীয় কমিটি তাদের সুপারিশ পর্যালোচনা করে ২২টি কোম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোসপেরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশ করে। এ বিষয়েও আদালত থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে ক্যান্সারের মতো মরণঘাতী রোগের ওষুধেও ভেজাল পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। টেকনো ড্রাগসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে ক্যান্সারের এই ভেজাল ওষুধ। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য অধিদফতর ২০টি ওষুধ কোম্পানির ওষুধ উৎপাদনের লাইসেন্স বাতিল করে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকেই চালিয়ে যাচ্ছে ওষুধ কারখানা। টেকনো ড্রাগস এ বিষয়ে সরকারের কাছে আবেদন করে বলেছে, দুই বছর আগে কমিটি কারখানা পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিয়েছে। এর মধ্যে কমিটির নির্দেশনা অনুসারে কারখানার মানোন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু সরকার তা আমলে না নিয়ে কারখানা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। টেকনোর পক্ষে পুনরায় কারখানা পরিদর্শনের আবেদনও করা হয়েছে। এদিকে, বিশেষজ্ঞ পরিদর্শক দলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জিএমপি মানদণ্ড অনুযায়ী ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে কিনা কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে তা-ই মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে কি কি কারণে কোন কোন কোম্পানির কোন কোন কারখানা বা কারখানার কোন ইউনিটের পেনিসিলিন, সেফালোসপেরিন, অ্যান্টিক্যান্সার ও হরমোন জাতীয় ওষুধ উৎপাদনে সক্ষম নয়, তা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব ওষুধ কোম্পানি ডব্লিউএইচও এবং জিএমপি গাইডলাইন অনুসরণে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে, এসব ওষুধ উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পেনিসিলিন ও সেফালোসপেরিন গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করা ২২টি কোম্পানির মধ্যে রয়েছে, আমিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, অ্যাজটেক ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, বেনহাম ফার্মাসিউটিক্যাল, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ডিসেন্ট ফার্মা, ড. টিআইএমস ল্যাবরেটরিজ, গ্লোবেক্স ফার্মাসিউটিক্যাল, গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল, ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যাল, মাকস ড্রাগস, মেডিম্যাট ল্যাবরেটরিজ, মডার্ন ফার্মাসিউটিক্যাল, মাইস্টিক ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, অর্গানিক হেলথ কেয়ার, ওয়েস্টার ফার্মা, প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যাল, সীমা ফার্মাসিউটিক্যাল, ইউনাইটেড কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল এবং হোয়াইট হর্স ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড। এ ছাড়া ১৪টি কোম্পানির সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোসপেরিন গ্রুপ) উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ ব্যবসায়ীরা জানান, নকল ভেজাল ওষুধ বাজার থেকে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসনের বা সংশ্লিট ওষুধ কোম্পানির। কোন কোম্পানির কোন ওষুধ সরকার বাতিল করেছে—তা আমরা জানি না। রোগীরা ওষুধ কেনেন প্রেসক্রিপসন দেখে। কোনো কোনো দোকানি হয়তো  প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করেন। তবে সবাই করে না। টেকনো ড্রাগসের টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট ড. লুত্ফর কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেগুলোর উৎপাদন বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা বন্ধ রয়েছে। তবে যেগুলো স্টকে রয়েছে সেগুলো চলবে। এ ছাড়া উৎপাদন বন্ধ করে দিলে সরকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে। শতাধিক ফার্মাসিস্ট এবং সহস্রাধিক কর্মকতা-কর্মচারী এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। তাই উৎপাদন বন্ধ না করে সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি দেড় বছরে ১৫টি নতুন এবং ৬৯টি পুরনো প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট ৮৪টি ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করে ২০১৫ সালে সংসদীয় কমিটির কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এই নির্দেশনার পরও অনেক প্রতিষ্ঠান পেনিসিলিন, সেফালোসপেরিন, অ্যান্টিক্যান্সার ও হরমোন জাতীয় ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে যাচ্ছে। তবে টেকনো ড্রাগস সংসদীয় বিশেষজ্ঞ টিমকে চ্যালেঞ্জ করে প্রকাশ্যেই উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম চালাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর