সোমবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সমস্যার শেষ নেই জবি শিক্ষার্থীদের

সুখে-দুঃখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

রাশেদ হোসাইন, জবি

সমস্যার শেষ নেই জবি শিক্ষার্থীদের

রাজধানীর অন্যতম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার শেষ নেই। দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। বিভিন্ন সমস্যাবাণে জর্জরিত এ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমস্যা আর সংকটের মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবন পার করছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার শিক্ষার্থী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ভর্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভর্তি হলেও তারা পাচ্ছেন না তেমন সুযোগ-সুবিধা। রাজধানীর অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টির আবাসন সমস্যার সঙ্গে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিবহন সমস্যা,  শ্রেণিকক্ষ সংকট। সমৃদ্ধ নয় গ্রন্থাগার, সেমিনার কক্ষ। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষে জুটছে না কাঙ্ক্ষিত সমাবর্তন। নামমাত্র মেডিকেল সেন্টার। খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একমাত্র খেলার মাঠ ধূপখোলা, যা খেলার অনুপযোগী। বিশুদ্ধ খাবারের পানির অভাব। ক্যান্টিনে খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় গলাকাটা দাম, যা দেখার কেউ নেই। নামে  বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এখানে কোনো সুযোগ-সুবিধাই পান না দেশের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য যান, নতুন উপাচার্য আসেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা  সমস্যা সমাধানের আন্দোলন করেন। সবাই আশ্বাস দেন। তড়িঘড়ি করে কমিটিও গঠন করা হয়। চলে চিঠি চালাচালিও। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। সমস্যা আর সংকট থেকেই যায়। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ১২টি হল থাকলেও বর্তমানে সেগুলো বেদখল হয়ে আছে। নামেমাত্র কিছু দখলে থাকলেও সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগের অভাবে তৈরি হয়নি কোনো ভবন। বাণী ভবন নামের একটি হলের এক অংশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা থাকেন। এ ছাড়া সৈয়দ নজরুল ইসলাম হলে ২৩ জন শিক্ষার্থী থাকেন, সেখানে শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা করে না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। হাবিবুর রহমান হলে কর্মচারী থাকলেও ভবন করার তাগাদা নেই প্রশাসনের। আবাসিক সুবিধা না থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীদের অনেক টাকা ব্যয়ে বাইরে থাকতে হয়। অন্যদিকে যাওয়া-আসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ পরিবহন বাস আছে তাও খুব কম। প্রায়ই বাসে জায়গা পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়ে পাবলিক বাসে করে যেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দফতর সূত্রে জানা যায়, ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ১৪টি বাস। এর মধ্যে ১২টি দ্বিতল, অন্য দুটি একতলা বাস। এ ছাড়া সাতটি বাস শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য। আর সিনিয়র শিক্ষকদের জন্য রয়েছে ছয়টি মাইক্রোবাস। অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে মাত্র একটি, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর তুলনায় একেবারেই নগণ্য। ৯২ ভাগ শিক্ষার্থী পরিবহন সুবিধার বাইরে। এক কথায় প্রতিনিয়ত অন্তহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন জবি শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় ছাত্রীদের। বাসগুলোতে ছাত্রীদের বসার আলাদা ব্যবস্থা না থাকায় দাঁড়িয়েই তাদের আসা-যাওয়া করতে হয়। ছাত্রীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত শৌচাগার। ভালো মানের বই লাইব্রেরি বা বিভাগীয় সেমিনারে না থাকলেও ছাত্রছাত্রীরা সেগুলো নিয়ে এক দিনের বেশি রাখতে পারেন না। বই নিয়ে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করা যায় না। জবিতে পাঠদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বইয়ের তীব্র অভাব। সরেজমিন দেখা যায়, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে কোনো বিষয়েরই পর্যাপ্ত বই নেই। সাংবাদিকতা, ইতিহাস বিভাগের সেমিনারে পর্যাপ্ত বই নেই। প্রায় প্রতিটি বিভাগের একই অবস্থা। সেমিনার আছে তো বই নেই। কয়েকটিতে থাকলেও অপর্যাপ্ত। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে ফটোকপি করার কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার্থীরা জানান, এখানে শ্রেণিকক্ষের সংকট অনেক বেশি। এক ব্যাচ ক্লাস করলে অন্য ব্যাচ ক্লাসের অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার শ্রেণিকক্ষ এমন যে সেখানে বসার জায়গা থাকে না। বিভাগীয় কমন কক্ষও নেই ছাত্রীদের। দু-একটি বিভাগে থাকলেও তাতে ছাত্রীদের বসার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাব নেই। পরীক্ষা থাকলে অন্যরা ক্লাস করতে পারেন না। প্রায় সব বিভাগের এ অবস্থা। সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্র শামিম আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা গ্রাম থেকে আসা দরিদ্র শিক্ষার্থী। থাকার জন্য কোনো আবাসিক হল নেই। বাইরে থাকা অনেক কষ্টসাধ্য। বাড়িওয়ালারা ব্যাচেলর বলে বাসা ভাড়া দিতে চান না। তাই হল খুব জরুরি। এর ওপর লাইব্রেরি ও ল্যাব সুবিধা অপ্রতুল। শ্রেণিকক্ষের সংকট। এতে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।’ বিগত ১১ বছরে হয়নি একটি সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে এক আইন পাসের মাধ্যমে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলেও অদ্যাবধি কোনো সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়নি। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অনীহার কারণে আজও কোনো সমাবর্তন হচ্ছে না। জানা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১১টি ব্যাচ ভর্তি হয়েছে। আবার এরই মধ্যে ১২তম ব্যাচ ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে। ৩৬টির মধ্যে ৩০টি বিভাগ থেকে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করার মাধ্যমে বের হয়ে গেলেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি সমাবর্তন। জবিতে নামেমাত্র একটি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। ২০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন ডাক্তার। তাও ওষুধ বাইরে থেকে কিনে নিতে হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের পরিধি ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। হ্রাস পাচ্ছে চিকিত্সাসেবা কার্যক্রম। নেই কোনো বেডের ব্যবস্থা। নেই পর্যাপ্ত ওষুধ। অসুস্থ হলে প্যারাসিটামল, হিস্টাসিন, স্যালাইন-জাতীয় প্রাথমিক ওষুধ ছাড়া কিছুই মেলে না জবি মেডিকেলে। এমনই অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের। জবি মেডিকেলের একমাত্র চিকিৎসক মিতা শবনম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের জনবল সমস্যা দীর্ঘদিনের। এ সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনেক দিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ হচ্ছে, যখনই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় তখন আবেদন পড়ে না। ফলে এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এখানে আছেন মাত্র দুজন মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট। এ ছাড়া ভার্সিটির পরিসর ছোট হওয়ায় মেডিকেলের পরিধি দিনে দিনে ছোট হচ্ছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার বিক্রি হচ্ছে উচ্চমূল্যে। ২ লিটার কোক ৮০ টাকা দিয়ে কিনে ১০০ মিলি ১০ টাকা করে ২০০-২৫০ টাকা বিক্রি করা হয়। নিম্নমানের তেহারি ৪০-৪৫ টাকা করে বিক্রি করা হয়। এসব বিষয় জানতে চাইলে জবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘সংকট উত্তরণে সব ধরনের চেষ্টা চলছে, যা শিক্ষার্থীরাও দেখছে। এসব সমস্যা এক দিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। আশা করি একে একে সব সমস্যা সমাধান হবে।’

সর্বশেষ খবর