মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

গরিবের চাল চুরিতে বেপরোয়া সচ্ছলরা

প্রতিদিন ডেস্ক

গরিবের ১০ টাকা কেজির চাল হরিলুটে ধনী এবং সচ্ছলরা হেন কাজ নেই—যা করছেন না। কেউ ঘুষ দিয়ে নিজেদের নামে কার্ড করে নিচ্ছেন, কেউ দলীয় প্রভাব কাজে লাগাচ্ছেন, কেউ দান করার কথা বলে বা মৃত ব্যক্তির নামে চাল উঠিয়ে নিচ্ছেন। লজ্জার মাথা খেয়ে বিত্তবানরা ভুয়া গ্রাম দেখিয়ে পর্যন্ত চাল আত্মসাৎ করার পন্থা অবলম্বন করেছেন। সরকারের মহতী উদ্যোগ এভাবে ভেস্তে যেতে থাকায় হতদরিদ্রদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

বড়লোকের ঘরে ১০ টাকার চাল : লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, লালমনিরহাটে হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রির কার্ড পেয়েছেন দলীয় নেতা, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, ধনী ও ব্যবসায়ীরা। জেলার ৪৫টি ইউনিয়নেই কার্ড বিতরণে এ অনিয়ম ঘটেছে। অধিকাংশ ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কার্ড নিয়ে চাল উত্তোলন করছেন। কয়েকটি ইউনিয়নে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের লোকেরা পেয়েছেন এ কার্ড। তা ছাড়া একই বাড়িতে একাধিক ব্যক্তিও কার্ড পেয়েছেন।

 হতদরিদ্রদের অনেকেই জানান, ‘টাকা দিতে না পারায় তাদের নামে কার্ড না হয়ে যারা সচ্ছল ও ১০-২০ বিঘা জমির মালিক—তাদের নামে কার্ড হয়েছে।’ একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জানান, তাদের ইউনিয়নে ১০-২০ বিঘা জমি রয়েছে এমন ব্যক্তিও কার্ড পেয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, জেলার কয়েকটি ইউনিয়নে দুই বছর আগে মারা গেছেন, এমন ব্যক্তির নামেও দশ টাকা কেজির চাল উত্তোলন করা হয়েছে। তবে মৃত ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য এই চাল পাননি। অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট এই চাল উত্তোলন করে কালোবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এভাবে তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে চলেছেন। এ দিকে প্রকৃত হতদরিদ্র রেশন কার্ডধারীরা চাল না পাওয়ায় তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। প্রতিদিনই তারা নিজ নিজ ইউনিয়ন পরিষদ ও চেয়ারম্যান-মেম্বারের বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন। তারপরও কালোবাজারি ও চাল আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল মহল কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভুক্তভোগীরা জানান, জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেও ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আলাল জানান, তার ইউনিয়নে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সহযোগিতা ছাড়াই তালিকা বানিয়ে ৮০ ভাগ সচ্ছল ব্যক্তির নামে কার্ড করে দিয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে প্রকৃত হতদরিদ্রদের। এ ব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গোলাম মওলা সরকারকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘দু-একদিনের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়নের তালিকা যাচাইয়ের জন্য অভিযান চালানো হবে। অনিয়মকারী কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’

তালিকায় নেতাসহ পরিবার : ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের সবার নামে হতদরিদ্রদের কার্ড দেওয়া হয়েছে। কার্ডপ্রাপ্তরা হলেন মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের, তার স্ত্রী দিলু আরা (কার্ড নং-১৬২), তার ৪ ভাই—রবিউল ইসলাম (কার্ড নং-১৪১), রেজাউল করিম (কার্ড নং-১৫৩), আখতার আলম (কার্ড নং-১৫৬), হোসেন আলী (কার্ড নং-১৬৩)। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আবদুল কাদের বলেন, ‘এসব অনুদান তুলে আমি স্থানীয় একটি এতিমখানায় দান করছি।’ অপরদিকে রানীশংকৈল উপজেলায় হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির তালিকায় আওয়ামী লীগ নেতা প্রভাষক সফিকুল আলমের নাম থাকায় এলাকায় আলোচনার ঝড় বইছে। জানা গেছে, ৮ নং নন্দুয়ার ইউনিয়নে বিধি মোতাবেক হতদরিদ্রের তালিকা প্রস্তুত করা কমিটি রয়েছে। সে কমিটির ঠাকুরগাঁও ৩ আসনের এমপি ইয়াসিন আলীর মনোনীত প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ নেতা প্রভাষক সফিকুল আলম। এ কমিটি যে ১৪২০ জনের নামের তালিকা প্রস্তুত করেছে, তাতে প্রভাষক সফিকুল আলমের নামও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান আবু সুলতান বলেন, ‘আমি এ কমিটির শুধু একজন সদস্য। আমার এখানে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। আমিও শুনেছি প্রভাষক সফিকুল আলমের নাম হতদরিদ্রদের তালিকায় রয়েছে। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মো. নাহিদ হাসান বলেন, ‘কমিটির মিটিং ডেকে সফিকুল আলমের নাম প্রত্যহার করা হবে।’

চারজনের নামে মামলা : নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, সুবিধাভোগী উপজেলাগুলোতে চাল বিতরণ শুরু হলেও চলছে নানা অনিয়ম। সুবিধাভোগীদের তালিকা প্রণয়নে অনিয়মের অভিযোগে ডোমার উপজেলার হরিণচড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ চারজনের নামে মামলা হয়েছে। ডোমার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মৃতুঞ্জয় রায় বর্ম্মণ বাদী হয়ে উপজেলার হরিণচড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলামসহ চারজনের নামে থানায় মামলাটি করেন। এদিকে নীলফামারী সদর, ডোমার ও ডিমলা উপজেলায় ১০ টাকা কেজি দরে হতদরিদ্রের মাঝে চাল বিতরণ শুরু হলেও এখনো এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও সৈয়দপুর উপজেলার দরিদ্ররা। এসব উপজেলায় দরিদ্রদের তালিকা প্রণয়ন ও অন্তর্ভুক্তকরণ এবং ডিলার নিয়োগে জটিলতা তৈরি হওয়ায় কর্মসূচি চালু করতে পারছে না খাদ্য বিভাগ।

ক্ষোভ এখন বিক্ষোভ : সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দরিদ্রদের ১০ টাকা কেজি দরের চাল নিয়ে চলছে নানা ফন্দিবাজি। তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও অনেকে চাল পাচ্ছেন না। নানা টালবাহানা করে ডিলাররা শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন দরিদ্রদের। এ নিয়ে দরিদ্রের ক্ষোভ এখন বিক্ষোভে রূপ নিতে চলেছে। এরই মধ্যে চাল না পাওয়ায় বিক্ষোভ-মানববন্ধন করেছেন হতদরিদ্র জনসাধারণ। গত রবিবার সকালে উল্লাপাড়ার পঞ্চক্রোশী ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ভোটার আইডি কার্ড ও তালিকা হাতে নিয়ে কয়েকশ হতদরিদ্র মানুষ বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া ভোক্তা চর দমদমা গ্রামের নুর হোসেন, জয়গন নেছা, দমদমা গ্রামের আহাদ আলী, চর দমদমার নুরু সেখ, বন্যাকান্দির রুবিয়া খাতুন, বেতকান্দি গ্রামের খাদেজা, কমলা, আবুল কালামসহ অনেকে জানান, তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও গত সেপ্টেম্বর মাসে চাল দেননি পঞ্চক্রোশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম ভুট্টোর স্ত্রী ডিলার ফেরদৌস আরা। চাল নিতে গেলে ‘তালিকায় নাম নেই’ বলে ফিরিয়ে দেন। ভুক্তভোগীদের দাবি, ফেরদৌস আরা ও তার স্বামী ভুট্টো মিলে গরিবে চাল কালোবাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। পূর্ব সাতবাড়ীয়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ইউনুস আলী প্রামাণিক জানান, ডিলার ফেরদৌস আরা তার সামনে বেশ কয়েকজন ভোক্তাকে চালের পরিবর্তে ৩শ টাকা দিয়ে বিদায় করেছেন। পঞ্চক্রোশী ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ উদ্দিন জানান, পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নে দুজন ডিলারের মাধ্যমে এক হাজার হতদরিদ্র পরিবারকে স্বল্পমূল্যের চাল বিতরণ করার কথা। কিন্তু ডিলার আইয়ুব আলী ফরিদ তার এলাকায় সুষ্ঠুভাবে চাল বিতরণ করলেও অপর ডিলার ফেরদৌস আরা চাল বিতরণে অনিয়ম করছেন। তিনি বলেন, ‘বেতকান্দি, কাজিপাড়া, দমদমা, রাঘবাড়ীয়া, কালিগঞ্জ ও মাটিকোড়া ওয়ার্ডের প্রায় দুই শতাধিক দরিদ্র ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। তালিকায় তাদের নাম রয়েছে, অথচ তারা চাল পায়নি। এ ছাড়াও সাখাওয়াত নামে কোনো গ্রাম না থাকলেও ওই গ্রামের ১৫ জনের নামে একটি ভুয়া তালিকা করে চাল আত্মসাৎ করা হয়েছে।’ ডিলার ফেরদৌস আরার স্বামী ও ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম ভুট্টো এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘চেয়ারম্যান ফিরোজ উদ্দিন আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার উদ্দেশ্যে গভীর ষড়যন্ত্রে নেমেছেন।’ উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সন্দীপ কুমার বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এ কথা সত্য নয়। তালিকার নামে কিছু গরমিল রয়েছে। সেগুলো সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত চালের ডিও দেওয়া হবে না।’

১৪৬০ পরিবার বঞ্চিত : বাগেরহাট  প্রতিনিধি জানান, মোড়েলগঞ্জ উপজেলার পুঁটিখালী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ চানমিয়া শামীমের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তার খামখেয়ালপিনার কারণে ১০ টাকা দরে চাল ক্রয়ের সুবিধা থেকে ওই ইউনিয়নের হতদরিদ্র ১৪৬০টি পরিবার বঞ্চিত হয়েছে। অভিযোগে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে একযোগে ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণ শুরু হলেও মোড়েলগঞ্জের কয়েকটি ইউনিয়ন চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বঞ্চিতরা। পুঁটিখালী ইউনিয়নের অর্ধশত হতদরিদ্র লোক এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে দায়ের করা ওই অভিযোগে ইউনিয়ন চেয়াম্যান শাহ চানমিয়া শামীমকে দায়ী করা হয়েছে। তবে ইউপি চেয়ারম্যান শাহ চানমিয়া শামীম অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘খাদ্যগুদামে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় এই ইউনিয়নের প্রথম মাসের চাল বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।’

সর্বশেষ খবর