মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইয়াবাই গড ফাদার!

চট্টগ্রামে মাদক আগ্রাসন - শেষ

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে সর্বনাশা ইয়াবাই এখন ‘গড ফাদার’। কারণ এ মাদকই তৈরি করেছে কোটিপতি, তৈরি করেছে জনপ্রতিনিধি। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রশাসন এবং সমাজ। যার কারণে কোনো সরকারি কর্মকর্তা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ঘাটাতেও সাহস পান না।

এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইয়াবার পাইপলাইনখ্যাত কক্সবাজারে বিগত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইয়াবা বিক্রির টাকার জোরেই অনেকে নির্বাচিত হয়েছেন। ওই নির্বাচনের সময় একেকজন চেয়ারম্যান, পৌর কাউন্সিলর, মেম্বার প্রার্থী ৩০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন। নির্বাচনে সহিংসতা না ঘটলেও ভোটারদের মধ্যে মাদকের অর্থ ব্যয় করে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রাতারাতি জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। চট্টগ্রামেও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অল্প সময়ে কোটিপতি হতেই ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায় জড়ান প্রভাবশালীরা। এখন তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। অনেক জনপ্রতিনিধি দলীয় প্রভাব খাটিয়েও মাদক ব্যবসা করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে বদলির ভয় থাকে। তাই ইচ্ছা থাকলেও মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাদক ব্যবসায় যুক্ত আছেন ইউপি মেম্বার থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য পর্যন্ত। শুধু মাদক ব্যবসা নয়, জনপ্রতিনিধিদের অনেকে আবার মাদকের বাহক হিসেবেও কাজ করছেন। এ বিষয়ে সমাজ বিজ্ঞানী ড. গাজী সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিরা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’ র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রাণালয় মাদক ব্যবসায়ীদের যে তালিকা তৈরি করেছে সেখানে অনেক জনপ্রতিনিধি আছেন। মূলত নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসা করতেই তারা জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। তবে আমাদের চোখে সব মাদক ব্যবসায়ীই সমান। তথ্য প্রমাণ পেলে কাউকেই গ্রেফতার করতে আমরা পিছপা হব না।’ এদিকে ব্যবসায়ী ছাড়া যারা মাদকের শিকার বা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন- তাদের জীবনে রয়েছে আরেক অধ্যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শখের বশে হোক, সঙ্গ দোষে হোক, আর নানান কারণে হতাশা থেকে হোক- একবার মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ার পর তারা কিছুতেই নেশা ত্যাগ করতে পারছেন না। মাদক তাদের গ্রাস করে ফেলেছে। সর্বস্ব খুঁইয়ে হলেও তাদেরকে নেশায় আসক্ত থাকতে হচ্ছে। ভুক্তভোগী অনেকেই জানান, ইচ্ছা থাকলেও তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না। পাশাপাশি ওয়াকেবহাল সূত্রগুলো বলছে, প্রয়োজনীয় নিরাময় কেন্দ্র এবং আবাসিক চিকিৎসার সুবিধা না থাকার  কারণেও যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না ২ লাখের অধিক মাদকাসক্ত। বিপুল এ মাদকাসক্তের বিপরীতে চট্টগ্রামে কাগজে-কলমে মাত্র ১১৫ মাদকাসক্ত আবাসিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় দশমিক শূন্য এক শতাংশের কম। আবার নারী মাদকাসক্তদের জন্য আবাসিক চিকিৎসা সুবিধা একেবারেই নেই। তাছাড়া বেসরকারি মাদকনিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে চিকিৎসা সেবার নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার নানা অভিযোগ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাদকাসক্ত রোগীর আত্মীয় বলেন, ‘বেসরকারি মাদক নিয়ময় কেন্দ্রগুলো চিকিৎসার নাম করে রোগী পিছু ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করছে। কিন্তু তারা ভালোভাবে চিকিৎসা তো দিচ্ছেই না, উল্টো  রোগীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে টাকা আদায় করছে। আবার কোনো কোনো নিরাময় কেন্দ্রের তদারককারীরা পর্যন্ত মাদকাসক্ত। ওইসব কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে গেলে রোগী আরও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।’ সরকারি-বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামে মাদকসেবীর সংখ্যা কমপক্ষে ২ লাখ। প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন নতুন মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকাসক্তদের সিংহভাগই ইয়াবা সেবন করেন। আসক্তদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক আলী আসলাম বলেন, ‘মাদকাসক্তের সংখ্যার তুলনায় আবাসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। পুরুষদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও নারী মাদকাসক্তদের আবাসিক চিকিৎসার সুযোগ নেই।’ প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, বাধ্যতামূলকভাবে বিনা খরচে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করানোর দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাস্তবে তার কিছুই করা হচ্ছে না। জেলাওয়ারি মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির বিধান থাকলেও তা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।

সর্বশেষ খবর