সোমবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

এশীয় ব্যবসার কেন্দ্রে বাংলাদেশ

রুহুল আমিন রাসেল

এশীয় ব্যবসার কেন্দ্রে বাংলাদেশ

দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য এখন এশিয়ামুখী। ক্রমেই বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে এশিয়া। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক দাপট বাড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার। এশিয়ার ১১ উদীয়মান অর্থনীতির দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। নিম্নআয়ের দেশের কাতার ছেড়ে বাংলাদেশ হাঁটছে মধ্যআয়ের পথে। প্রবৃদ্ধির উত্থান গতির ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়ে আসছে প্রায় এক যুগ। এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থল। শুধু ভারত, চীন, জাপান বা রাশিয়াই নয়, বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর অনেক দেশ ও সংস্থার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশে।

এ সবকিছু মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থল বা হাব হিসেবেই মূল্যায়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক এই গভর্নর গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ খুবই সম্ভাবনাময়। আমাদের চারটি কাজ বা প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলছে। এগুলো হলো— নগরায়ণ, প্রযুক্তি বা ডিজিটালাইজেশন, শিল্পায়ন এবং তারুণ্যশক্তি। ২৫ বছরের নিচে আছে আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক মানুষ। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়াগুলো ঠিকমতো এগিয়ে গেলে তখন বাংলাদেশের সঙ্গে আশপাশের দেশগুলো পেরে উঠবে না। দেশের অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলো সঠিকভাবেই এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এই খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ।  ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য বদলাতে শুরু করেছে। ব্যবসাটা এখন চলে এসেছে এশিয়াতে। সারা বিশ্ব এখানে বিনিয়োগে ঝুঁকছে। এশিয়ার এই অঞ্চলে সবচেয়ে সফল বাংলাদেশ। কারণ এক যুগ ধরে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি-জিডিপি ৬ শতাংশের ওপরে। এটা কোনো দেশই দেখাতে পারবে না। যার ফলে আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সবার কাছ থেকে এমন বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাচ্ছি। আঞ্চলিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার মূল্যায়ন হলো— বিশ্ব অর্থনীতিতে এগিয়ে চলা এশিয়ার দেশগুলোর বিকাশমান প্রবৃদ্ধির নয়া কেন্দ্রবিন্দু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতসহ এই উপাঞ্চল। কারও মতে, এই শতাব্দী এশিয়ার। গত ৩০ বছরে অনেক বদলে গেছে বাংলাদেশ। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে অধিকাংশই দরিদ্র হলেও মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে গড়ে ৭ শতাংশ। বেশ কিছু সামাজিক মানদণ্ডে বন্ধু প্রতিবেশী ভারতকেও টপকে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। চীন এক নম্বর হলেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। প্রতিবছর এক কোটি প্রবাসী বিদেশ থেকে টাকা পাঠান। সব মিলিয়ে দ্রুত বিকশিত হওয়া এই অর্থনীতির দিকে নজর পড়েছে অনেকের। গত শুক্রবার চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিংপিংয়ের ঢাকা সফরের প্রথম দিনেই বাংলাদেশের প্রতি ভারত, জাপান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের আগ্রহের ধারাবাহিকতা ছিল লক্ষ্যণীয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ৪০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পায় বাংলাদেশ। এ দেশের ইতিহাসে বিদেশি বিনিয়োগের এমন ঘটনাকে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক কৌশলগত অবস্থানকে আরও শক্ত করার, আরেকটু উল্লেখযোগ্য বা উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছ। এর সঙ্গে বহু দেশীয়, বহুপক্ষীয় ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক যে দাঁড়াচ্ছে, তা ভারসাম্যপূর্ণভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার চ্যালেঞ্জটাও অনেক বড়। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা আছে। এখানে বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ আছে। তবে ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে একটা ভারসাম্য করে চলতে হবে। বড় বড় দেশের বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে সবাই আগ্রহী। তবে বাংলাদেশকে একটা ভারসাম্য (ব্যালেন্স) করে চলতে হবে। সবার কাছ থেকে কৌশলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে হবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস— পিডব্লিউসি গবেষণার তথ্যমতে, ২০৫০ সালে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির শক্তি হবে বাংলাদেশ। ২০১৪ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মাত্র তিনটি দেশের জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হবে। এই তিন দেশ হলো— বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া ও ভিয়েতনাম। মূলত একটি দেশের অর্থনীতি কতটা বড় ও শক্তিশালী, সেটি নির্ধারণে সর্বস্বীকৃত দুটি উপায় আছে। একটি হলো ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে জিডিপির আকার, অন্যটি হলো বাজার বিনিময় হারের (এমইআর) ভিত্তিতে জিডিপির আকার। দুই হিসাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতি উঠে এসেছে। পিপিপির ভিত্তিতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৫৩ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৫৩৬ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের ৩১তম বৃহৎ অর্থনীতি। ১ হাজার ২৯১ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে বিশ্বে ২৯তম। ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে বিশ্বে ২৩তম। তখন জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। সংস্থাটির গবেষণা বলছে, বিনিময় হারের ভিত্তিতেও বড় হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এমইআর হিসেবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৩২তম। এ হিসাবে ২০৫০ সালে বিশ্বের ২৮তম হবে বৃহৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি। এই ৩৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখনকার তুলনায় ১৩ গুণ বড় হবে। এখানেই শেষ নয়, সুখবর আছে আরও। পিপিপির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি চীনের প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালের পর কমবে। এর ফলে বহুজাতিক পশ্চিমা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে তাদের পণ্য উৎপাদনের জন্য বেছে নেবে। এতে রপ্তানিনির্ভর অনেক শিল্প এই দেশগুলোতে চলে আসবে এবং উচ্চ বেতনের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ফলে আগামী ৩৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আরেকটি ভালো খবর হবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রবৃদ্ধি। এই সময় বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যোগ হবে। জিডিপির বিপরীতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিও আগামী ৩৫ বছরে বাড়বে বাংলাদেশে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে জিডিপির বিপরীতে বিনিয়োগ হবে গড়ে ২১ দশমিক ২ শতাংশ, পরবর্তী সময়ে এ বিনিয়োগ বেড়ে হবে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ। পিডব্লিউসি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে আগামী ৩৫ বছরে সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে চীনের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। ২০৩০ সালে এমইআরের হিসাবেও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে চীন। ওই গবেষণায় জিডিপির দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় ৩২টি দেশের অর্থনীতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে এখনই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৩২টি অর্থনীতির একটি হলো বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর