বুধবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

এবার বিনিয়োগ বহরে ইরান

ডিসেম্বরে ঢাকায় আসছেন ইরানি প্রেসিডেন্ট, হবে মহাসড়ক সমুদ্রবন্দর

রুহুল আমিন রাসেল

এবার বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে আসছে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশ ইরান। ভারত, জাপান ও চীনের পর এখন ইরানি বিনিয়োগের হাতছানিতে বাংলাদেশ। এ দেশে মহাসড়ক-সমুদ্রবন্দর, জ্বালানি, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল খাতে বিনিয়োগ করতে চায় এক যুগের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কাঠিয়ে ওঠা ইরান। একই সঙ্গে ওষুধ, পোশাক ও কৃষিপণ্য রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার আগ্রহ নিয়ে ঢাকা সফরে আসছেন ইরানের রাষ্ট্রপতি ড. হাসান রুহানি। তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

তথ্যমতে, ১৯৯৫ সালে ইরানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাফসান জানি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। পরে ১৯৯৭ সালের ওআইসি সম্মেলন এবং ২০১২ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে ইরান সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন করেন। এরপর দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের কোনো সফর বিনিময় না হলেও গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ জারিফ ও চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে পাঁচ দিনের ঢাকা সফরে আসে ইরানের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল। পরে চলতি বছরের মাঝামাঝি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দল যায় ইরানে। আর সর্বশেষ চলতি অক্টোবর মাসের শুরুতে ইরান সফরে যান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। এমন প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের শেষ দিকে ইরানের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশটির উচ্চপর্যায়ের নেতারা বাংলাদেশ সফর করবেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইরান এশিয়ায় বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থনৈতিক শক্তির এই দেশটির অবরোধের কারণে ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জব্দ ছিল। জানা গেছে, ইরানে বাণিজ্য বাড়লেও পরবর্তী সময়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় দেশটির ওপর পরমাণু ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবরোধ। পরমাণু ইস্যুতে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় গত বছর ১৪ জুলাই ইরানের সঙ্গে বিশ্ব পরাশক্তিদের (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, জার্মানি ও জাতিসংঘ) ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ইরান তার নাতানাজ পরমাণু প্রকল্পের সেন্ট্রিফিউজ ১৯ হাজার থেকে কমিয়ে ৬ হাজার ১০৪টিতে নিয়ে আসবে। এখন দীর্ঘ ১২ বছর পর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বৈশ্বিক এ ঘটনায় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যে বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে নতুন দিগন্ত হাতছানি দিচ্ছে। জানা গেছে, ইরানে বাংলাদেশি চিকিৎসক, প্রকৌশলী, চালক, বিক্রয়কর্মীসহ অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি শ্রম সস্তা তাই চাহিদা ব্যাপক। পাট, চামড়াজাত পণ্য, হস্তশিল্প, প্যাকেটজাত খাবারসহ বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা রয়েছে ইরানে। দেশটির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর পাইপলাইনের মাধ্যমে ইরানের জ্বালানি আনতে পাকিস্তান ও ভারত যে চুক্তি করেছে, তা সম্প্রসারণ করে বাংলাদেশও কীভাবে লাভবান হতে পারে এ পরামর্শ অনেকের। ঢাকার ইরান দূতাবাস সূত্র জানায়, বাংলাদেশকে অশোধিত তেল আমদানিতে বিশেষ সুবিধা দিতে চায় ইরান। বাংলাদেশের একমাত্র তেল পরিশোধন কেন্দ্র ইস্টার্ন রিফাইনারির সংস্কার ও সক্ষমতা বাড়াতেও সহযোগিতা দেবে দেশটি। এটি ইরানের সহযোগিতায়ই নির্মাণ করা হয়েছিল। সিলেটে আবিষ্কৃত বাংলাদেশের তেলক্ষেত্রেও সহযোগিতায় আগ্রহী ইরান। মূলত তেল রপ্তানি, পরিশোধন কেন্দ্রে সহায়তা ও তেলক্ষেত্র অনুসন্ধানে সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে চায় তারা। আর বাংলাদেশ জ্বালানি চাহিদা পূরণে যে পরমাণু শক্তি নিয়ে কাজ করছে, তাতে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর উন্নয়নে সহযোগিতা করতে আগ্রহী ইরান। এমনকি বাংলাদেশে আরও পরমাণু বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে সহায়তা দিতে চায় দেশটি। জানা গেছে, ইরানের সঙ্গে বিশ্বনেতাদের চুক্তিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক এ চুক্তির ফলে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে বলে মনে করেন সরকারের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীরা। ২৫ জুলাই দেশের ১৫টি ব্যবসায়ী গ্রুপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জ্বালানি খাতের নতুন উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠান স্টার ইনফ্রাসট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে ইরানের সারভি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। এ উদ্যোগের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জে স্থাপিত কারখানা দেশে এলপিজি সরঞ্জাম অর্থাৎ এলপিজি সিলিন্ডার, এলপিজি ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টোরেজ ট্যাংক, গৃহস্থালি ও যানবাহনে ব্যবহূত সিলিন্ডার উৎপাদন করা হবে। পাশাপাশি সিলিন্ডার ট্যাংক বহনের জন্য বড় আকারের বুলেট ট্রাকও আমদানি করা হবে। প্রাথমিকভাবে ১২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে স্টার ইনফ্রাসট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কনসোর্টিয়াম লিমিটেড এক বছরের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা। এদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ওঠার পর ঢাকা সফরে আসা ইরানের ব্যবসায়ীরা ৬ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগে আগ্রহী প্রকাশ করেন। তখন ঢাকায় নিয়োজিত ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজি বলেছিলেন, বাংলাদেশে ব্যবসার পরিকল্পনা ও বাজার-বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের সুফল পেলে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা এরও বেশি সরাসরি বিনিয়োগ হতে পারে। জি টু জি (দুই দেশের সরকার থেকে সরকার) বা বেসরকারি খাতে এ বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে এলপিজি, এলএনজি, সিমেন্ট ও এর ক্লিঙ্কার, প্লাস্টিক ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করতে চায় ইরান। ড. আব্বাস ভায়েজির মতে, ইরানের লক্ষ্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানো। ইরান কেমিক্যাল ও প্লাস্টিকের কাঁচামাল, তেল, সিমেন্টের ক্লিঙ্কারসমৃদ্ধ দেশ। এ খাতগুলোতে তারা যৌথভাবে বিনিয়োগে আগ্রহী। এ জন্য একটি নতুন চুক্তি হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ-ইরানের বাণিজ্য সম্ভাবনা এখন অনেক ভালো।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর