মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

প্রশ্ন ফাঁসের ফাঁদে ভর্তি পরীক্ষা

মোবাইল ফোন ও ব্লু-টুথের মাধ্যমে পরীক্ষা কেন্দ্রেই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে উত্তর

আকতারুজ্জামান

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস থেমে নেই। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার কখনো ভর্তি পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্ন চলে যাচ্ছে জালিয়াত চক্রের হাতে। স্বল্প সময়ে প্রশ্ন সমাধান করে তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভর্তিচ্ছুদের মুঠোফোনে অথবা ব্লু-টুথ ডিভাইসের মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রশ্নের সমাধান। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন মিলেছে পরীক্ষার আগেই। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পাওয়া গেছে এ বিদ্যাপীঠে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর। এ ছাড়াও দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ মেলে হরহামেশাই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের কারণে অসাধু কিছু শিক্ষার্থী উপকৃত হলেও বিপাকে পড়ছেন মেধাবী ভর্তিচ্ছুরা। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধু শিক্ষক, কর্মকর্তা অথবা কর্মচারীর সহায়তায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে চলে যাচ্ছে জালিয়াত চক্রের হাতে। আর চক্রটি স্বল্প সময়ে প্রশ্নপত্র সমাধান করে পৌঁছে দিচ্ছে ভর্তিচ্ছুদের কাছে। মাঝে-মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরীক্ষার্থীদের ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরেই। তবে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তার সহযোগিতা ছাড়া প্রশ্নফাঁস সম্ভব নয়। সময় এসেছে যেকোনো মূল্যে এই প্রশ্নফাঁসে সহায়তাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার। গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে ১৩ ভর্তিচ্ছুকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জানান, পরীক্ষা চলাকালে তারা মোবাইল ফোনে এসএমএস ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতি করছিল। জানা যায়, পরীক্ষা শুরু হওয়া মাত্রই বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন হলে দায়িত্বরত শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সহায়তায় কেন্দ্রের বাইরে চলে যায়। সেখান থেকে সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র প্রশ্নপত্র সমাধান করে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে এসএমএসে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়া বাইরে থেকে কেউ কেউ মোবাইল ফোনে উত্তর জানিয়ে দিচ্ছিল। আর কয়েক শিক্ষার্থী ব্লু-টুথ ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতিতে অংশ নেয়। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশ্নফাঁস জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে হাতেনাতে ধরার পর তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত এখনো এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর সঙ্গে যদি শিক্ষক-কর্মকর্তার যোগসাজশের প্রমাণ মেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ মেলে। ভর্তি পরীক্ষার দশ মিনিট আগেই প্রশ্নফাঁস চক্রের হাতে চলে যায় পরীক্ষার প্রশ্ন। ক্যাম্পাসসংলগ্ন বিসিএস কনফিডেন্স কোচিং সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের উত্তর মোবাইলের মেসেজের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠানোর সময় এক তরুণকে আটক করা হয়। পালিয়ে যায় আরও এক তরুণ। এ চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আটক করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সাইফ আহম্মেদ লিখনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় কোচিং খোলা রাখার অপরাধে কোচিং সেন্টারের পরিচালক মফিজুর রহমান রনিকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। জানা যায়, এক ভর্তিচ্ছুর মোবাইলের ইমোতে পরীক্ষার দশ মিনিট আগেই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন সমাধান করে পাঠিয়েছিল প্রশ্নফাঁসকারী চক্র। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর উদয়ন স্কুলের সামনে একশো টাকা দামে পরীক্ষার আগেই বিক্রি হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফটোকপি প্রশ্ন। প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত চার অভিযুক্তকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হলেও কাদের মাধ্যমে প্রশ্ন বাইরে চলে আসে এমন মূল হোতারা অধরাই থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার করে প্রশ্ন বাইরে চলে যায়। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ৩০টি কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার দশ মিনিট পূর্বে প্রশ্নপত্র বের করে কেউ মোবাইলে ছবি তুলে বাইরে পাঠিয়েছে। পরে সেগুলো কোচিং সেন্টার সমাধান করে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ জড়িত নয়, দাবি করেন তিনি। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ মেলে মাঝে মধ্যেই। শিক্ষাবিদরা বলছেন, যে কোনো মূল্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের কোনো বিকল্প নাই। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে।

সর্বশেষ খবর