মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

এমপি মোস্তাফিজের সাম্রাজ্যে ভালো নেই আওয়ামী লীগ

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

এমপি মোস্তাফিজের সাম্রাজ্যে ভালো নেই আওয়ামী লীগ

চট্টগ্রাম-১৬ বাঁশখালী সংসদীয় আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থী হয়েই এক লাফে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে যান এই সংসদ সদস্য। বাঁশখালী থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমূল পরিবর্তন হয় তার জীবনধারাতেও। একসময়ের শান্ত স্বভাবের মোস্তাফিজুর হয়ে যান রগচটা। ‘পান থেকে চুন খসলে’ই তেড়ে আসেন যে কাউকে মারতে। কথায় কথায় হুমকি দেন গুম-খুনের। সরকারি কর্মকর্তা থেকে সাংবাদিক, দলীয় নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ— এমন অনেকেই শিকার হয়েছেন তার আক্রোশের। জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত, দলীয় নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। তার এমন কর্মকাণ্ডে বিব্রত খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও।অভিযোগের বিষয়ে জানতে সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর মোবাইল ফোনে গতকাল একাধিকবার কল ও এসএমএস দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি। তবে তিনি ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন। বাঁশখালীর সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মৌলভী নুর হোসেন বলেন, ‘সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বাঁশখালীতে জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুরো বাঁশখালীকে অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী তার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে মামলা দিয়ে হয়রানি করেন।’

বাঁশখালী আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীও অভিযোগ করেন, বাঁশখালীতে জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শহীদ মিনারে জামায়াত নেতাদের নিয়ে ফুল দেওয়া, জামায়াত-শিবির নেতাদের পরিচালিত হজ কাফেলার মাধ্যমে হজে গমন, জামায়াত নেতাকে নিয়ে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনসহ ছাত্রশিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে সমালোচিত এই সংসদ সদস্য। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলের সঙ্গে দক্ষিণ পুঁইছড়ি মদিনাতুল উলুম মোহাম্মদীয়া মাদ্রাসার বার্ষিক সভায় অতিথি হয়েছিলেন এমপি। জামায়াতের সাবেক আমির শফিউল্লাহর সভাপতিত্বে আয়োজিত এ সভার জন্য সংসদ সদস্য ও সাঈদীপুত্রের নামে পোস্টারও সাঁটানো হয়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেই সমালোচনা হলে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।

দক্ষিণ জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও বাঁশখালীর পুকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকতার হোসেন বলেন, ‘আমাদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এলাকায় এমপির গ্রুপ করি না। তাই আমাকে এবং আমার ভাইদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বেশ কয়েকটি মামলা দেওয়া হয়েছে। শুধু আমরা নই, বাঁশখালীর অনেক আওয়ামী লীগার ও সাধারণ লোকজন এমপির রোষানলে পড়েছেন।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রার্থী হায়দার আলীকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোস্তাফিজুর রহমান। এ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তার রাজনৈতিক গুরু সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত সুলতান উল কবির চৌধুরী। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই শীলকূপ ও সরল ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ নির্মাণের অনিয়ম নিয়ে সুলতান কবির প্রতিবাদ করলে তার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন মোস্তাফিজ। পরে রাজনৈতিক গুরু সুলতানকে বাদ দিয়ে আলাদা বলয়ে রাজনীতি শুরু করেন। এরপর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। নামে-বেনামে সরকারি প্রকল্প বরাদ্দ ও অনিয়ম এবং এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিজের লোকদের দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এই সংসদ সদস্য। ঘটনার একপর্যায়ে তিনি মুজিবকে মারতে তেড়ে যান। গত ১ জুন বাঁশখালীর ইউপি নির্বাচনের আগমুহূর্তে পছন্দের প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ না দেওয়ায় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলামকে মারধর করেন এই এমপি। এ ঘটনার পরপরই নির্বাচন কমিশন বাঁশখালীর নির্বাচন স্থগিত করে। সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেয়। এ ঘটনায় জাহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, তার এপিএস তাজুল ইসলাম ও ওলামা লীগ নেতা মৌলানা আক্তারকে আসামি করে মামলা করেন। সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর বাঁশখালী উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে তথ্য চাওয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দৈনিক পূর্বদেশের স্টাফ রিপোর্টার রাহুল দাশকে হত্যা ও লাশ গুম করার হুমকি দেন। এ ঘটনায় রবিবার চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন এমপির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে কর্মসূচি পালন করে। এই সংসদ সদস্যের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলেই দলীয় নেতা-কর্মীদের পড়তে হয় রোষানলে। পুলিশকে ব্যবহার করে দলীয় নেতা-কর্মীদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য। তার রোষানলে পড়েছেন এমন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর মধ্যে রয়েছেন পুঁইছড়ি ইউনিয়নের আবদুল খালেক, বৈলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার লিটন চক্রবর্ত্তী, নাজিম চৌধুরী, ছনুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, চাম্বল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবুল হক সিকদারসহ আরও অনেকে। এমপির হুমকির শিকার সাংবাদিক রাহুল দাশ বলেন, ‘সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে রিপোর্ট করতে অফিস থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয় আমাকে। বাঁশখালীর উন্নয়ন বিষয়ে রিপোর্ট করতে তথ্য অধিকার আইনে নির্দিষ্ট ফরমে প্রকল্প কর্মকর্তার কাছে আবেদন করি। আবেদনের পর সংসদ সদস্য ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে হত্যা ও লাশ গুমের হুমকি দেন। এ ঘটনার পর জীবনের নিরাপত্তা ও প্রতিকার চেয়ে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আবেদন করেছি।’

সর্বশেষ খবর