মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

সম্মাননা পাচ্ছেন সেই রুশ সৈনিকরা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নৌবন্দরে পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া মাইন অপসারণ ও পানিতে ডুবানো জাহাজ উত্তোলন অভিযানে অংশ নিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) নৌবাহিনীর সদস্যরা। তাদের এই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশটির পাঁচ অবসরপ্রাপ্ত নৌ সেনাকে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্মাননা গ্রহণকারীদের সস্ত্রীক ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের বিমানে আসা-যাওয়া এবং থাকা-খাওয়াসহ ঢাকায় অবস্থানের যে খরচ হবে তা বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। এ বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে— উপরে উল্লিখিত মহতী কর্মযজ্ঞে নিবেদিত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের মধ্য থেকে আমন্ত্রণ প্রেরণের জন্য পাঁচজন সদস্যের নাম (স্ত্রীসহ) সংগ্রহের অনুরোধ করা হলো। প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের পক্ষে উইং কমান্ডার রফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে রাশিয়ান দূতাবাসের মাধ্যমে সংগৃহীত নাম সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর এই চিঠিটি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় রাশিয়ান নৌ সেনাদের সহায়তা সম্পর্কিত লিখিত একাধিক তথ্য থেকে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের আগমুহূর্তে চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বেশ কয়েকটি শক্তিশালী মাইন পুঁতে রাখে। এ সময় তারা নদীর চ্যানেলে বেশকিছু জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। এর ফলে বিজয়ের আগমুহূর্ত থেকে ওই চ্যানেলে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর নদীতে পুঁতে রাখা এসব শক্তিশালী মাইন ও নিমজ্জিত জাহাজ অপসারণের জন্য ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশ সরকার ও সোভিয়েত সরকারের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর মাইন অপসারণে বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উদ্ধারকারী দল পাঠায় রাশিয়া। সাগরপথে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন রাশিয়ান নৌবাহিনীর সাবেক ভাইস অ্যাডমিরাল এসপি জুয়েলকো। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রাম অংশে প্রবেশ করেই তারা কাজে লেগে যান। টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে এ দলের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করেন। এ সময় তারা উদ্ধার করেন ২৬টি ডুবন্ত যুদ্ধ জাহাজ। এ ছাড়া উদ্ধার করেন প্রায় ১০ লাখ টন জাহাজের যন্ত্রাংশ ও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পাটাতন। একই সঙ্গে তারা নিষ্ক্রিয় করেন অসংখ্য মাইন ও বোমা। তাদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের মাঝামাঝি ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলাই ঘটে দুঃখজনক একটি ঘটনা। নিষ্ক্রিয় করার আগমুহূর্তে হঠাৎ বিস্ফোরিত হয় একটি মাইন। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের ফ্লোটিং ওয়ার্কশপ পিআই-১৫৬’র সিনিয়র নাবিক ইউরি ভিকতোরোভিচ রেডকিন। পরে তার লাশ উদ্ধার করে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় নেভাল একাডেমি এলাকায় সমাধিস্থ করা হয়। রেডকিনের বাবা রেডকিন ভিক্তর আন্দ্রেভিচ ও মা ভ্যালেন্তিনা ইলিনিচনা একবার তার স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করতে এদেশে আসেন। তাদের প্রিয় ছেলের দুঃখজনক মৃত্যুতে বাংলাদেশের তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে তাদের একটি চিঠি লিখেন সেই সময়। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রশস্ত এক পথের ঠিক শুরুতে তার তরুণ জীবন থেমে গেছে। যাহোক, মানুষের জীবনের মূল্য পরিমাপ করা হয় জীবনের মেয়াদকাল দিয়ে নয়, তার ভালো কাজের মাধ্যমে। সেজন্য নিঃসন্দেহে আপনাদের ছেলের প্রিয় ও উজ্জ্বল স্মৃতি তার দেশের মানুষ, বাংলাদেশের জনগণ এবং বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মী ও কর্মকর্তাদের হূদয়ে চিরদিন জেগে থাকবে। আমি আশা করি এটি এরকম এক বিশাল ক্ষতিতে আপনাদের কষ্ট কিছুটা হলেও কমাবে।’

 

 

সর্বশেষ খবর