বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হঠাৎ বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা

বেশি শিকার হচ্ছে কিশোরী তরুণীরা ৯ মাসে গেছে ৩৩ প্রাণ

জিন্নাতুন নূর

দেশে সব বয়সী নারীর প্রতি সহিংসতা ও ইভ টিজিং আবারও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। তবে বখাটেদের হামলার শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগামী কিশোরী ও তরুণীরা। বিগত কয়েক দিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বখাটেদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে মারাত্মক আহতও হয়েছে কয়েকজন। নির্যাতিত ছাত্রীদের অনেকেই এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। উদ্বেগের বিষয়, বখাটেরা স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করছে। কখনো আবার মুঠোফোনে এই যৌন হয়রানির দৃশ্য ধারণ করে নির্যাতিতার পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করছে তারা। অপমান ও ভয়ে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের পড়ালেখা। এরই মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বখাটের নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে ৩৩ জন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সমাজে মানুষ এখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। কোনো মেয়ে ইভ টিজিংয়ের শিকার হলে বা বখাটের হামলার শিকার হলেও তাকে বাঁচাতে মানুষ আর এগিয়ে আসেন না। এ বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষ নির্বিকার। তাই কোনো ছেলে যাতে বখাটে হয়ে না ওঠে এ জন্য পরিবারগুলো থেকে ভালো-মন্দ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। নারী যে কোনো পণ্য নয়, তাকে সম্মান করতে হবে, এ বিষয়ে ছেলেদের সচেতন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিক্ষিপ্তভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও কিশোরীদের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন তেমন একটা দেখা যায় না। আর স্কুল-কলেজে শুধু নামেই ইভ টিজিং প্রতিরোধ কমিটি গড়ে না তুলে এর দায়িত্বপ্রাপ্তদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ কমিটিকে ছাত্রদের ইভ টিজিং না করার ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। মানবাধিকারকর্মী ও ‘নিজেরা করি’র প্রধান খুশী কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বখাটেদের হাত থেকে রক্ষার জন্য ছাত্রীদের আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে হবে। এর পাশাপাশি মেয়েদের নিয়ে বখাটে ও ছাত্রদের গত্বাঁধা মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে বখাটে ও দুর্বৃত্তদের উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩৩টি প্রাণ ঝরে পড়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর আত্মহত্যা করেছে সাতজন। এ সময় ৫১২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর ১২১ ঘটনায় ভিকটিমের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। উল্লেখ্য, বেশ কয়েক বছর আগে শিক্ষার্থীদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যৌন নির্যাতনবিরোধী কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। এর বাইরে উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি ইস্যুতে দেশের সব জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ামাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার এবং দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ডিসিদের নির্দেশসহ মোট পাঁচ দফা নির্দেশনা জারি করেছেন উচ্চ আদালত। কিন্তু এত কিছুর পরও বখাটেদের উত্ত্যক্ততা বন্ধ করা যাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রিশা হত্যার আগেও আমরা দেখেছি, সেনানিবাসের মতো নিরাপদ স্থানে তনু নামের আরেক শিক্ষার্থীকে নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়। আমি মনে করি, এসব হত্যার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিশ্চিত করা না গেলে তনু, রিশা, মিতু ও ইয়াসমিনদের একের পর এক হত্যার শিকার হতে হবে।’ তার মতে, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের কারণে অপরাধীদের বিচার হচ্ছে না। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

সর্বশেষ গাজীপুরের কালিয়াকৈরে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় গতকাল জেএসসি পরীক্ষার্থী মুন্নীকে (১৫) স্থানীয় প্রভাবশালী আতাউর সরকারের ছেলে আরাফাত সরকার শ্বাসরোধে হত্যা করে। জানা যায়, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে মুন্নীকে উত্ত্যক্ত করত আরাফাত। এ ব্যাপারে আরাফাতের স্বজনদের কাছে বিচার দিলেও তারা বিষয়টি আমলে নেননি। এ নিয়ে আরাফাত উল্টো মুন্নী ও তার বাবাকে হত্যার হুমকি দেয়। এই বখাটের যন্ত্রণায় একপর্যায়ে মুন্নীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ১ নভেম্বর পরীক্ষার জন্য ফের স্কুলে যাওয়া শুরু করে সে। এ সময় মুন্নীকে নানাভাবে ভয় দেখায় আরাফাত। অবশেষে গতকাল ভোরে নিজ ঘরে ওড়না পেঁচানো অবস্থায় মেয়েকে মৃত অবস্থায় পান মুন্নীর মা-বাবা। এ সময় আরাফাতকে মুন্নীদের ঘরের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। এ ছাড়া রাজধানীর বিসিআইসি কলেজের দুই ছাত্রীকে বুধবার পিটিয়ে আহত করে স্থানীয় বখাটেরা। এতে এক ছাত্রীর পা ভেঙে যায়। ছাত্রীরা জানান, কলেজ ছুটির পর ওই বখাটেরা তাদের প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। তবে বুধবার এর প্রতিবাদ করায় দুই বোনকে বাঁশ দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সিলেট ছাত্রলীগের এক নেতার চাপাতির আঘাতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে জীবন ফিরে পেয়েছেন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা বেগম। টানা কয়েক দিন অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান ফিরেছে মেয়েটির। বর্তমানে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। ৩ অক্টোবর বিকালে এমসি কলেজ কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পথে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম প্রকাশ্যে পৈশাচিক কায়দায় শারীরিক নির্যাতন করে খাদিজাকে। এ ছাড়া একই দিন প্রেমে সাড়া না দেওয়ায় মাদারীপুর জেলার শিবচরে জেএসসি পরীক্ষার্থী এক ছাত্রীকে হত্যার চেষ্টা করে নূর আলম নামের আরেক বখাটে। মাদবরের চর ইউনিয়নের সাড়ে বগোরো রশি এলাকার প্রবাসী বজলু বয়াতীর ছেলে নূর আলম দীর্ঘদিন ধরেই মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ১৮ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় নিতু মণ্ডল নামের ১৫ বছরের এক কিশোরীকে একই গ্রামের মিলন মণ্ডল নামের বখাটে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে নিতুকে দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করে আসছিল মিলন। অন্যদিকে বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর মাগুরা সদর উপজেলার সাংদা লক্ষ্মীপুর গ্রামের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী হ্যাপী (১২) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এর আগে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে ছুরিকাঘাতে মারাত্মক জখম করে ওবায়দুল খান নামের আরেক বখাটে। এরও আগে ২৭ মে কণিকা ঘোষ (১৫) নামের দশম শ্রেণির আরেক ছাত্রী আবদুল মালেক নামের এক বখাটের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। শিক্ষকের বাসায় প্রাইভেট পড়া শেষে কণিকা বাড়িতে ফেরার পথে এ নির্মম ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কণিকার সঙ্গে গুরুতর আহত হয় তার আরও তিন সহপাঠী।

সর্বশেষ খবর