বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নিমিষেই তৈরি হয় ডলার হাজার টাকার নোট

আলী আজম

নিমিষেই তৈরি হয় ডলার হাজার টাকার নোট

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালিয়ে গতকাল বিপুল পরিমাণ জাল নোট ও ডলার উদ্ধার করে পুলিশ

চোখের পলকেই তৈরি হয় ডলার, হাজার টাকার নোট। নিখুঁতভাবে তৈরি হচ্ছে এসব মুদ্রা। ইচ্ছা করলেই যে কেউ এটা আসল না নকল তা ধরতে পারবে না। দুই ঈদসহ বড় বড় উৎসব এলেই জাল টাকা তৈরি চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় ব্যবসায়ী এবং ক্রেতারা ব্যস্ত থাকেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকে লেনদেনের চাপ। আর এ সুযোগ কাজে লাগায় জাল টাকার চক্র। রাজধানীতে জাল টাকা তৈরির অর্ধশত চক্র সক্রিয় রয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাব এ চক্রের একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করলেও জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও একই পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। গত দুই দিনে এমনই জাল নোট তৈরি চক্রের ১৩ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে জাল মুদ্রা প্রতারক চক্রের ১০ জনকে ডিএমপির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ এবং সৌদি রিয়াল প্রতারক চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন বলেন, মঙ্গলবার ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডা এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পৃথক অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জাল মুদ্রাসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন রফিকুল ইসলাম ওরফে রফিক, জাহাঙ্গীর, নিজাম, শহিদ, মাস্টার আবদুর রহিম, জাকির, মাহমুদ, বাবুল হোসেন, আলামিন ও আলকাস শেখ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫৬ লাখ জাল টাকা, ৩৫০০ জাল ইউএস ডলার, জাল টাকা তৈরির কাজে ব্যবহৃত ৪টি ল্যাপটপ, ৭টি প্রিন্টার, ২টি ১০০০ টাকার নিরাপত্তা সুতার বান্ডিল, একটি ৫০০ টাকার নিরাপত্তা সুতার বান্ডিল, ৭টি টাকা বানানোর স্ক্রিন ডাইস, ২টি টাকা কাটার গ্লাস, গাম, স্কেল, খাম, ১৮০০টি এপসন প্রিন্টার কালির কার্টিজ, ১০০ কৌটা প্রিন্টিং কালি, ১০০ পিস টাকা তৈরির কাগজ, ২ কেজি জাল টাকা তৈরির পাউডারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। যুগ্ম কমিশনার আরও বলেন, জাল টাকা তৈরির মূল কারিগর রফিক। সে ১৫ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। রফিক একসময় জাল টাকার মাস্টার সগীরের সহযোগী হিসেবে ছিল। পরবর্তীতে মাস্টার জাকির, মাস্টার বাদশা, মাস্টার মুজিবের সঙ্গে সে ব্যবসা করত। তার তৈরি করা জাল টাকা সবচেয়ে নিখুঁত ও উন্নত মানের হওয়ায় বাজারে চাহিদা অত্যন্ত বেশি। আবদুর রহিম জাল টাকার কাগজগুলো তৈরি করে ও কাটিং করে বলে স্বীকার করে। র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে সৌদি রিয়াল প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন আবুল কালাম ওরফে কালাম, আবু তালেব ওরফে আতিক এবং হাবিবুর রহমান ওরফে চন্দন। এ সময় তাদের কাছ থেকে সৌদি ৫০ রিয়াল মূল্যমানের ২টি আসল নোট এবং সৌদি ৫০ রিয়ালের সমমূল্যের ৩৯৮টি সাদা কাগজ উদ্ধার করা হয়। আসামিরা সবাই ময়মনসিংহের বাসিন্দা এবং এরা বিভিন্ন সময় ঢাকা শহরে এসে এ ধরনের প্রতারণা করে নিরীহ মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। পুলিশ ও র‌্যাব বলছে, জাল নোট তৈরির চক্রগুলোর মধ্যে এখন টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, তার টাকার দাম তত বেশি, বিক্রিও বেশি। নিখুঁতের মানদণ্ড অনুযায়ী এক লাখ টাকার বান্ডিল ১২ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় অর্ধশত জাল নোট তৈরি চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি চক্রে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ওই চক্রের বেশ কয়েকজন হোতাসহ একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেউ কেউ জামিনে বেরিয়ে ফের একই পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। জাল নোটের কারবারিরা ধরা পড়লেও সাক্ষীর অভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ চক্রের হোতাদের নেটওয়ার্কে থাকে খদ্দের ও কামলা বলে দুই শ্রেণির মানুষ। খদ্দেররা সরাসরি কোম্পানি থেকে পাইকারি দরে জাল নোট কিনে নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে তাদের কাছ থেকে অল্প পরিমাণে নোট কিনে নেন কামলা বা খুচরা বিক্রেতারা। তারা সাধারণত এক হাজার টাকার ১০টি নোট অর্থাৎ ১০ হাজার টাকা কেনে তিন হাজার টাকায়। অন্যদিকে খদ্দেররা মানভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় কেনে এক হাজার টাকার নোটের ১০০টির এক বান্ডিল। ওই পরিমাণ জাল টাকা উৎপাদনে কোম্পানির খরচ পড়ে মাত্র তিন থেকে চার হাজার টাকা। জাল নোট তৈরির ক্ষেত্রে চারটি ভাগে কাজ হয়। এক ভাগের লোকজন শুধু নিরাপত্তা সুতা তৈরি করে। দ্বিতীয় ধাপের লোকজন ওই সুতা কিনে জলছাপসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিশেষ ধরনের কাগজ তৈরি করে। ওই কাগজ কিনে নেয় কোম্পানি বা চক্রের হোতারা। আরেক ধাপের লোকজন টাকার মূল ডিজাইন করে। জাল টাকা তৈরি চক্রের সদস্যরা ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে থাকে ডিজাইন, নিরাপত্তা সুতা বেষ্টিত কাগজে দেওয়া হয় প্রিন্ট। প্রতিমুহূর্তে বেরিয়ে আসছে টাকা কিংবা ডলার। এ কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নজরে আসা খুবই কঠিন।

সর্বশেষ খবর