শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ধর্ষকরা প্রভাবশালী

অনেক ঘটনা ধামাচাপা, ৯ মাসে ধর্ষণের শিকার ২৫৩২ জন, মামলা ৬৩০

মাহবুব মমতাজী

ধর্ষকরা প্রভাবশালী

দেশে হঠাৎ বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন। ধর্ষণ ছাড়াও নির্মম পাশবিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। আর এ ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাবে আইনি হাত থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্ষকরা। ধর্ষণের ঘটনার পর আহতরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলেও মাঝপথে এসে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এমন অসংখ্য ঘটনা থাকলেও প্রায় ২০ শতাংশ নারী বছরের পর বছর মামলায় লড়ছেন ধর্ষকদের বিরুদ্ধে। অধিকাংশের পরিবার বিভিন্ন চাপে প্রভাবিত হয়ে আইন-আদালতের ঝামেলা এড়িয়ে যাচ্ছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়ে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৫৩২ জন এবং এর মধ্যে মামলা করেছেন ৬৩০ জন। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। কর্মকর্তারা বলছেন, ভুক্তভোগীদের পরিবার থেকে মামলা করতে না চাওয়ায় তা আদালতে গড়ায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা আর পরিবেশগত কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে। আমাদের দেশের গ্রামেগঞ্জে লাখ লাখ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তার বেশির ভাগই ধামাচাপা পড়ে যায়। যে ঘটনাটি চাপা দেওয়া যায় না সেটিই আলোচনায় চলে আসে। ভুক্তভোগীদের পরিবার থেকে বলা হচ্ছে, তাদের ওপর নানা ধরনের চাপ থাকে। আর বিষয়টি নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া হলে তা তাদের মান-সম্মানের প্রশ্নে এসে দাঁড়ায়। সম্প্রতি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। যার ফলে শিশুটির প্রজনন অঙ্গে দেখা দিয়েছে সংক্রমণের শঙ্কা। যেজন্য এখনই শিশুটির ওপর কোনো ধরনের অস্ত্রোপচারে যাচ্ছেন না চিকিৎসকরা। বিষয়টি মিডিয়ায় আলোচিত হওয়ার কারণে ধর্ষক গ্রেফতার হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগ থেকে জানা যায়, গত ২ এপ্রিল অজ্ঞান অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি হয় নেত্রকোনার একটি মেয়ে। ওই ঘটনার ধর্ষকের নাম আরিফ। সে স্থানীয় প্রভাবশালীর ছেলে। গত ৫ মে মেয়েটির মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া মেয়েটি তার জবানবন্দিতে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণের কথা উল্লেখ করেন। তাতে আরও বলা হয়, আরিফ তাকে পরীক্ষার শিট নেওয়ার কথা বলে তার ঘরে নিয়ে যায়। আর সে সময় তার ওপর নির্যাতন চালায়। রিপোর্ট প্রকাশের পরই চিকিৎসকরা আইনানুগ ব্যবস্থার বিষয়ে তার পরিবারের কাছে জানতে চান। কিন্তু পরে তারা বিষয়টি নিয়ে আদালতে যেতে আগ্রহী নন বলে জানান। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, ‘আমরা গরিব। নানা দিক থেকে চাপ আছে বিষয়টা দ্রুত সমঝোতা করার। এ ছাড়াও ভয় থাকে যদি সমঝোতায় না গিয়ে আরও বেশি কোনো ক্ষতি করে ফেলে তারা।’ এ বিষয়ে আরিফের বাবা আকবর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মুঠোফোন বন্ধ করে দেন। জানতে চাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের পরিচালক ড. আবুল হোসেন বলেন, আদালতে অসংখ্য মামলা জমা পড়ে আছে যে কারণে ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচার হতে সময় লাগছে। আর যতগুলো ঘটনা ঘটে তার বেশির ভাগই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে না। আর তারা এগিয়ে না আসলে আমাদেরও কিছু করার থাকে না। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনাগুলো বাড়ার কারণ হলো ইন্টারনেটের অপব্যবহার। এতে পরিবেশগত কারণও রয়েছে। ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতার কারণের অনেকের শারীরিক ও মানসিক বিকৃতি ঘটে। আর এসব সমাধানের জন্য পারিবারিক সচেতনতা এবং নৈতিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে হবে। দিনাজপুরে নির্মম পাশবিক নির্যাতনের শিকার শিশুটির চিকিৎসার করণীয় ঠিক করতে গঠিত মেডিকেল বোর্ড গতকাল সকালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তারা শিশুটিকে উচ্চক্ষমতার ওষুধের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একই সঙ্গে সরকারিভাবে শিশুটির সব ধরনের চিকিৎসা ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মিজানুর রহমান। হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. অধ্যাপক আশরাফ-উল হক কাজল জানান, শিশুটির প্রজনন অঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত। সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। যদি সংক্রমণ রক্তে ছড়ায়, তাহলে বিষয়টি ভয়াবহ হবে। তার এখন পুষ্টির অভাব রয়েছে। তাই শিশুটিকে পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর তার প্রজনন অঙ্গে অস্ত্রোপ্রচার করতে আরও দেড় থেকে দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে। গত ১৮ অক্টোবর পার্বতীপুর উপজেলার সিঙ্গীমারী জমিরহাট গ্রামের ওই শিশু বাড়ির সামনে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়। সন্ধান না পেয়ে ওইদিন রাতে তার বাবা পার্বতীপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরদিন ভোরে বাড়ির পাশে একটি হলুদ ক্ষেত থেকে শিশুটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পার্বতীপুর ল্যাম্প হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার আরও অবনতি হলে গত সোমবার রাতে ছয়দিন পর একটি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় শিশুটিকে ঢামেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়। গত ২০ অক্টোবর রাতে শিশুটির বাবা একই গ্রামের জহির উদ্দিনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৪২) ও আফজাল হোসেন কবিরাজকে (৪৮) আসামি করে পার্বতীপুর মডেল থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি সাইফুলকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও অপর আসামি পলাতক রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর