রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রশ্নফাঁসে জালিয়াত চক্র

প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রশ্নপত্র হচ্ছে ফাঁস

আকতারুজ্জামান

কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না প্রশ্ন ফাঁস চক্রকে। মাঝে-মধ্যে এ চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু ভর্তিচ্ছুকে শাস্তির আওতায় আনা হলেও মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পরীক্ষার আগেই কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন চলে যাচ্ছে এই চক্রের হাতে। সেখান  থেকে মুহূর্তেই শিক্ষার্থীর মুঠোফোন, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসও বাদ যাচ্ছে না। এতে মেধাহীনরা আপেক্ষিকভাবে পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও সুদূরপ্রসারী ক্ষতিতে পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, যে কোনো মূল্যে প্রশ্ন ফাঁসের লাগাম টেনে ধরতে হবে। নয়তো জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরীক্ষার প্রশ্ন যদি হলের বাইরে চলে যায় তবে সেটি অবশ্যই উদ্বেগের। কিছু নীতিহীন শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর কর্মকাণ্ডে আমরা উদ্বিগ্ন। হল থেকে প্রশ্ন বের করে দিতে শিক্ষক বা শিক্ষার্থী যদি সম্পৃক্ত হন তবে আমরা কার ওপর ভরসা করব? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় এমন অভিযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। মাধ্যমিকে এমন অনিয়ম রোধকল্পে এমসিকিউয়ে দশ নম্বর কমানো হয়েছে। আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীরা হলে উপস্থিত হলে জালিয়াতদের অপচেষ্টা অনেকটাই কমে আসবে, অভিমত দেন নাহিদ। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভুয়া প্রশ্ন দিয়েই জালিয়াত চক্র শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে। তাই এক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে আশাব্যক্ত ব্যক্ত করেন মন্ত্রী।

আগামী ১ নভেম্বর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি), জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেডিসি) পরীক্ষা শুরু হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে জালিয়াত চক্র। পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্ন ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক এ প্রতিবেদকের কাছে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, প্রায় প্রতিবছরই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে জেএসসি পরীক্ষায়। তাই সন্তানের আবদার, একটি ট্যাব কিনে দিতে হবে। কারণ, হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন চলে আসবে পরীক্ষার আগেই। সেক্ষেত্রে বড় স্ক্রিন হলে সুবিধা পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, তার সহপাঠীরা নাকি প্রশ্ন পাবে তাই এখন থেকেই তার পড়াশোনার ওপর অনীহা দেখতে পাচ্ছি। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস, বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে দেওয়ার আশ্বাসে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে তত্পর রয়েছে জালিয়াত চক্র। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্ন ফাঁস থেমে নেই। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার কখনো ভর্তি পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্ন চলে যাচ্ছে জালিয়াত চক্রের হাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। গত শুক্রবার ঘ ইউনিটের পরীক্ষার আগে বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে ভর্তিচ্ছুরা পাঠ্যবই না পড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া প্রশ্নের উত্তর পড়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষা শুরুর পর দলে দলে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেছেন। আর নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই পরীক্ষা শেষ করেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে জালিয়াতিতে অংশ নেওয়ায় সাত ভর্তিচ্ছুকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ মেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও (জবি)। গত শুক্রবার পরীক্ষা চলাকালে একটি কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ের পরে এক ভর্তিচ্ছু দেয়াল টপকে প্রবেশ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তার সহযোগিতা ছাড়া প্রশ্ন ফাঁস সম্ভব নয়। আর শর্ষের ভিতর যদি ভূত থাকে, তাহলে সেই ভূত তাড়াবে কে? শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। তারা  অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে জাতি কার কাছে শিক্ষা নেবে?

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বরখাস্ত দুই : শুক্রবার ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শুরুর আগেই একটি কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলে সেখান থেকে দুটি প্রশ্ন সরিয়ে ফেলে কে বা কারা। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক শিক্ষকসহ দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, দায়িত্বে অবহেলার জন্যই এই শিক্ষকদের বরখাস্ত করা হয়। জবি প্রতিনিধি জানান, ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে দায়িত্বে অবহেলা ও নৈতিকতাবিরোধী কাজের অভিযোগে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক দেওয়ান বদরুল হাসান ও কর্মচারী মো. এমদাদুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে  জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এ ঘটনায় আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সরকার আলী আক্কাসকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগে বা পরীক্ষা চলাকালীন বাইরে পাঠানোর সঙ্গে শিক্ষকরাই জড়িত থাকে বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেছেন জবির উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। উপাচার্যের বরাত দিয়ে প্রতিনিধি জানান, কিছু অসাধু শিক্ষক মোবাইল ফোনে ছবি তুলে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মাধ্যমে প্রতারক চক্রের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

সর্বশেষ খবর