মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আতঙ্ক, আড়াই হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আতঙ্ক, আড়াই হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা

ভীতসন্ত্রস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে নাসিরনগরের গ্রামগুলো। রবিবার দিনভর তাণ্ডবের পর গতকাল উপজেলা সদরে উদ্বেগ আতঙ্ক বিরাজ করে। সাধারণ মানুষের আনাগোনাও কমে যায় বাজারগুলোতে। জেঠাগ্রাম, নুরপুর, নরহা, হরিণবেড়, দত্তপাড়া, ফার্মগেট বাজার এলাকার দোকানপাট গতকাল দুপুরের দিকেও বন্ধ দেখা গেছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে স্থানীয়রা জানান, রবিবার হামলার পর আতঙ্ক থেকেই দোকানপাট তেমন খুলছেন না ব্যবসায়ীরা। আতঙ্কে উদ্বিগ্ন পরিবারের কর্তারা নারী-পুরুষকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তবে পুলিশ বলছে, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছে নাসিরনগরের জনজীবন। রবিবার মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে পুরো ঘটনা তদন্তে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গতকাল বিকালে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নাসিরনগরে শান্তি-সম্প্রীতি সমাবেশ হয়। সমাবেশ থেকে মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরকারীদের বিচার দাবি করা হয়। পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। গৌরমন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় এর সাধারণ সম্পাদক নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে প্রায় দেড় হাজার জনকে আসামি করে মামলা করেন। দত্তবাড়ির দুর্গাপ্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায়ও কাজলজ্যোতি দত্ত মামলা করেন। এ মামলায় আসামি করা হয় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে। পুলিশ জানিয়েছে, এসব মামলায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে রবিবার রাতে ছয়জন ও গতকাল সকালে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে হামলায় অংশগ্রহণকারীদের নাম-ঠিকানা জেনে তাদেরও মামলায় আসামি করা হবে। তবে দুই মামলায়ই অজ্ঞাত লোকদের আসামি করা হয়েছে। এদিকে সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপসারণ দাবি করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে নাসিরনগরের পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সংখ্যালঘুদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। দত্তবাড়ির কমলা দত্ত বলেন, ‘আমরা আতঙ্কে রয়েছি। হামলার সময় শিশুরা ভয়ে চিৎকার করছিল।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমরা তো অপরাধ করিনি। যে অপরাধ করেছে তার বিচার হোক। আমরা এর বিচার চাই।’ গীতা দাস বলেন, ‘হামলার পর থেকে আতঙ্কিত অবস্থায় আছি। কখন যে কী হয়!’ গতকালও পুলিশের পাশাপাশি বিজিবির সদস্যদেরও রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে। নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের জানান, দুটি মামলাতেই অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। তবে গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে নামধাম সংগ্রহ করে হামলাকারীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, হামলাকারীদের গ্রেফতারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। এদিকে গতকাল বিকালে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমেদের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক মো. রেজওয়ানুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, নাসিরনগর উপজেলা চেয়ারম্যান এ টি এম মনিরুজ্জামান সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেব ও হামিদা লতিফ পান্না। শান্তি সমাবেশে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে কাবা শরিফকে অবমাননা করে আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরও একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে রবিবার বিভিন্ন মন্দির ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমন করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ ও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাদেরের দ্রুত অপসারণ দাবি করা হয়েছে। রবিবার রাতে স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গোলাম মহিউদ্দিন খান খোকন স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘নাসিরনগরে সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ করে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছি। নাসিরনগরের ঘটনায় জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ‘আমি এ ঘটনায় মর্মাহত। যারা অপরাধী তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের নিষ্ক্রিয়তা, ব্যর্থতা ও উসকানিই এ ঘটনার জন্য দায়ী।’

প্রসঙ্গত, শুক্রবার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাস (৩০) কাবা শরিফ অবমাননা করে মহাদেবের মূর্তি কাবা শরিফের ওপর বাসিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। আপত্তিকর এ ছবি প্রকাশের পর শনিবার স্থানীয় লোকজন রসরাজকে ধরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় শনিবার রাতেই রসরাজের বিরুদ্ধে নাসিরনগর থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়। রবিবার এ নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা। উত্তেজিত জনতা উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করে বেশকিছু হিন্দু বাড়িঘর এবং দত্তবাড়ি মন্দির, জগন্নাথবাড়ি মন্দিরসহ ১২টি মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাব গিয়ে বেলা ৩টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

সর্বশেষ খবর