মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নির্দোষ দাবি, সাত খুনের আসামিদের

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার বাকি ১৯ আসামিকে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষ হয়েছে। গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে ১৯ আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনান রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন। এরমধ্যে ১৪ জন নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনো সাফাই সাক্ষী বা লিখিত বক্তব্য না দিয়ে বিচারকের কাছে ন্যায় ও সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন। তবে মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের পাঁচ সহযোগী আদালতকে বলেন, তারা নূর হোসেনকে চেনেন না। তাদের নির্যাতন করে ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাদা কাগজে সই নেওয়া হয়েছে। সাবেক পাঁচ র‍্যাব সদস্য নিজেদের নির্দোষ দাবির পাশাপাশি আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য বিচারকের কাছে উপস্থাপন করেন। এর আগে গত ২৪ অক্টোবর প্রধান চার আসামি নূর হোসেন, র‍্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানাকে দণ্ডবিধি ৩৪২ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। ৩৫ আসামির মধ্যে ১২ আসামি এখনো পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো গেল না বলে আদালতকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন। তিনি আইনের বিধান অনুযায়ী পলাতক আসামিদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আদালতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গ্রেফতার সব আসামিকে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষ হলে বিচারক যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য আগামী ২১ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।

গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় ২৩ আসামির মধ্যে যে ১৯ আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। তারা হলেন— র‍্যাব সদস্য এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এএসআই বজলুর রহমান ও আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার এমদাদুল হক ও নাসির উদ্দিন, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন ও বাবুল হাসান, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, বেলাল হোসেন, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন, সিপাহি আবু তৈয়ব, নুরুজ্জামান ও আসাদুজ্জামান নূর এবং নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশার। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে পূর্ব পরিকল্পনা, পরস্পর যোগসাজশ ও অর্থের বিনিময়ে র‍্যাব সদস্যদের সহায়তায় সাতজনকে অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুম করার অভিযোগ আনা হয়। এক এক করে অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর জানতে চাওয়া হয়—অভিযোগের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? উত্তরে প্রত্যেকেই পৃথক পৃথকভাবে বলেন, আমরা নির্দোষ। এরপর প্রশ্ন করা হয় আপনি সাফাই সাক্ষী দেবেন কি না? প্রত্যেকে না সূচক উত্তর দেন। এরপর আবারও জানতে চাওয়া হয়—এর বাইরে আর কিছু বলবেন কি না? উত্তরে নয় আসামির প্রত্যেকে এক এক করে বলেন, আমরা বিচারকের কাছে ন্যায় বিচার চাই। আর পাঁচ আসামির মধ্যে আলী মোহাম্মদ আদালতকে বলেন, আমি আগামী তারিখে লিখিত বক্তব্য দিতে চাই। আদালত বলে না আজই দিতে হবে। তখন সে আদালতকে বলেন, আমাকে জোর করে ধরে এনে রিমান্ডে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাদা কাগজে সই নিয়েছে। আমি কখনো নূর হোসেনের চাকরি করিনি। আমার নিজস্ব ব্যবসা আছে। আসামি আবুল বাশার বলেন, নির্যাতন ও হত্যার হুমকি দিয়ে সাদা কাগজে সাক্ষর নিয়েছে। আমি নূর হোসেনকে চিনি না। আমি নির্দোষ। আসামি রহম আলী কাঠগড়ার ভিতর দুই পায়ের কাপড় উঠিয়ে ক্ষত চিহ্ন দেখিয়ে বলেন, আমাকে মেরে ল্যাংড়া বানিয়ে দিয়েছে। চামড়া তুলে ফেলেছে। ছয় মাস ধরে হাঁটতে পারি না। কোমর ব্যথায় নামাজ পড়তে পারি না। উপরের দিকে ঝুলিয়ে পিটিয়েছে। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাদা কাগজে সাক্ষর নিয়েছে। আমি নূর হোসেনকে চিনি না। আমি ডেমরায় থাকি। আমি নির্দোষ। আসামি মিজানুর রহমান বলেন, আমি ড্রাইভার না। গাড়ি চালাতে জানি না। নূর হোসেনকে চিনি না বলাতে বেশি মেরেছে। ১৯ দিন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে পায়ের নখ উঠিয়ে ফেলেছে। কিছু নাম লিখে দিয়ে বলে এই নামগুলো বলবি। আমি নূর হোসেনকে চিনি না। আমি এই মামলায় প্রতিহিংসার শিকার। বাকি পাঁচ আসামি সিপাহি আবু তৈয়ুব, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, হাবিলদার এমদাদুল হক, সৈনিক আসাদুজ্জামান নুর ও এএসআই বজলুর রহমান তাদের আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খোকন সাহা আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, জেরার সময় আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, যে স্থান থেকে ট্রলারে লাশ উঠানো হয়েছিল, অর্থাৎ কাঁচপুরের ল্যান্ডিং স্টেশন শীতলক্ষ্যা নদীর কোন পাড়ে অবস্থিত। জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন ল্যান্ডিং স্টেশন শীতলক্ষ্যা নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত। মামলার স্বার্থে ল্যান্ডিং স্টেশন শীতলক্ষ্যা নদীর কোন পাড়ে তা নির্ণয়ের জন্য আদালতের কাছে কমিশন নিয়োগের আবেদন জানাচ্ছি। তখন আদালত তার এই আবেদন নামঞ্জুর করে অ্যাডভোকেট খোকন সাহার কাছে জানতে চান, আপনি বলেন, ল্যান্ডিং স্টেশন শীতলক্ষ্যা নদীর কোন পাড়ে? অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন পশ্চিম পাড়ে। আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, গতকাল ১৯ আসামিসহ সব আসামিকে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষ হয়েছে। তাদের তিনটি করে প্রশ্ন করা হয়। তারা সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আদালত যুক্তিতর্কের জন্য আগামী ২১ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন। তিনি আরও বলেন, ল্যান্ডিং স্টেশন শীতলক্ষ্যা নদীর কোন পাড়ে তা নির্ণয়ে কমিশন নিয়োগের জন্য আইনজীবীর আবেদনটি আদালত নামঞ্জুর করে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নাসিকের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ তার পাঁচ সহযোগীকে অপহরণ করা হয়। একই সময় একই স্থান থেকে অপর একটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকারকে নজরুলের সহযোগী ভেবে তাকে ও তার গাড়ির চালককেও অপহরণ করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকার তীর থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি এবং নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাতা বাদী হয়ে একই থানায় অপর একটি মামলা দায়ের করেন।

সর্বশেষ খবর