বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

স্মৃতির কারাগারে জনতার ঢল

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্মৃতির কারাগারে জনতার ঢল

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে রাখা কেন্দ্রীয় কারাগারের সেই সেলের সামনে দর্শনার্থীদের ভিড় (উপরে) কারাগারে ঢুকছেন উৎসুকরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

অবশেষে উন্মুক্ত হলো পুরাতন কারাগার। প্রথম দিনই কৌতূহলী মানুষের ঢল নেমেছে। টিকিট সংগ্রহ, এরপর প্রবেশে দীর্ঘ লাইন। দর্শনার্থীদের পদচারণে পুরো এলাকাটি মুখরিত হয়ে ওঠে। অথচ আগে যার নাম নিলে মনে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে যেত। আর অনেকেই এখন আগ্রহ নিয়ে সেখানে ভিড় জমিয়েছেন। ২২৮ বছরের এই কারাগারকে ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস আর ঐতিহ্য। বেশি দিনের কথা নয়, প্রায় মাস দু-এক আগেও সেখানটা ছিল বেশ শোরগোল। এপার আর ওপার। খোলা চোখে একই মনে হলেও মনে হতো দুটি জগৎ। সুযোগ ছিল না এপারের মানুষের সঙ্গে স্বাধীনভাবে মেশার। একসময় স্বজনরা দীর্ঘ অপেক্ষা করে দেখা করেছেন ওপারের মানুষের সঙ্গে। যাদের রাখা হয়েছিল আলোর সন্ধান দিতে। যে জায়গাটিতে থাকা অবস্থায় মুখে হাসি ফুটেছে কারও। আবার কেউ কেউ অঝরে কেঁদেছেন চিরবিদায়ের সংবাদে। হাসি-কান্নার নানা স্মৃতি জুড়ে রয়েছে তার আনাচে কানাচে। মহান নেতাদের আত্মত্যাগ আর নির্মম মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী। এ স্থানেই বহুল আলোচিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে পাঁচ যুদ্ধাপরাধীকে। এমনিভাবে নানা জনের উত্থান-পতনের ঘটনাপ্রবাহ আগলে দীর্ঘ বছর পার করেছে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারটি। এখন সেটি পরিত?্যক্ত। গত ২৯ জুলাই কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে বন্দী স্থানান্তরের মাধ্যমে সেটি সাবেক কারাগারে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগেও যেটিতে প্রবেশে ছিল ধরাবাঁধা নিয়ম। তাতে এখন সর্বস্তরের মানুষের আনাগোনা। সেখানে যেতে পারছে সবাই। জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে গতকাল এ কারাগারকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এতে ছিল চিত্র প্রদর্শনী; যা চলবে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত। এ সময় বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার রাজনৈতিক স্মৃতিবিজড়িত ১০০ ছবি নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী করা হবে। ১০০ টাকার টিকিটে ভিতরে প্রবেশ করে এসব দেখার সুযোগ পাবে সবাই। বাঙালি জাতির দীর্ঘ বছরের সংগ্রামের সাক্ষী এ ঐতিহাসিক নিদের্শনটি দেখতে ছিল নানা মানুষের কৌতূহল। প্রদর্শনীর প্রথম দিনে কর্তৃপক্ষ খুলে দিলেও পুরো স্থাপনা ঘুরে দেখার সুযোগ পাননি দর্শনার্থীরা। বেঁধে দেওয়া সময়ে চলে ‘সংগ্রামী জীবনগাথা’ শিরোনামে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোকচিত্রের প্রথম প্রদর্শনী। কারাগারে আগতদের চোখে পড়ে ভিন্ন ধরনের কিছু আয়োজন। মূল ফটক পেরিয়ে কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়বে দক্ষ শিল্পীর নিপুণ হাতে গড়া অপূর্ব এক শিল্পকর্ম। এ শিল্পকর্মটি অনেক বছর আগে এক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। তার কিছুটা সামনেই আয়োজন করা হয়েছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী। তার ঠিক উল্টো দিকে কারা গার্মেন্ট। যেখানে একসময় সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া কয়েদিরা কাজ করতেন। সঙ্গে আছে কর্মবণ্টন রুম। তবে কিছু জায়গায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় জনসাধারণের কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই কক্ষে তার ব্যবহূত থালা, বিছানা, চেয়ার দেখার সুযোগ পান দর্শনার্থীরা। ‘কারাগারের নাম শুনলেই ভয়ে আমার ভিতরটা কেঁপে উঠত। আর এখন এর ভিতরে কী আছে, এখানে মানুষ কীভাবে থাকত তা দেখার আগ্রহ বেড়ে গেছে’— বলছিলেন সালমা নামে এক শিক্ষার্থী। তিনি থাকেন আজিমপুর কলোনিতে। তার পড়াশোনা ইডেন মহিলা কলেজে। সোহরাব নামে আরেক দর্শনার্থী জানান, ‘ভিতরে কয়েকটি পরিত্যক্ত গুদামঘর দেখেছি। তা দেখে একটু অবাক হলাম। কিছুদিন আগেও জীর্ণ এই গুদামঘরগুলোয় কর্মচাঞ্চল্য ছিল। যেখানে বন্দীদের খাবারের রুটির উপাদান রাখা হতো।’ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখার জন্য নির্ধারিত কনডেম সেলে উন্মুখ জনতার ভিড় ছিল অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে একটু বেশি। যেখানে একসঙ্গে আটজন কয়েদিকে রাখার ব্যবস্থা ছিল। তার পাশেই রয়েছে মূল ফাঁসির মঞ্চ। এ মঞ্চেই যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাতীয় চার নেতা— প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে বন্দী করে ঢাকার এই কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। এরপর ৩ নভেম্বর রাতে কারাগারের ভিতরই হত্যা করা হয় তাদের। প্রতি বছর এ দিনটি ‘জেলহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

সর্বশেষ খবর