শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

চিকিৎসাসেবার বেহাল দশা

রাজধানীর ছয় ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ ও চারটির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ

আহমেদ সেলিম রেজা

চিকিৎসাসেবার বেহাল দশা

রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাসেবার বেহাল দশা পরিদর্শনে মাঠে নেমেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। মাঠে নেমেই তারা দেখতে পায়, যেসব সরকারি হাসপাতালে সর্বাধুনিক সুবিধা আছে, সেখানে প্রয়োজনীয় ডাক্তার ও নার্স নেই। আবার যেখানে ডাক্তার ও নার্সের কোনো অভাব নেই, সেখানে যন্ত্রপাতি অকার্যকর। চিকিৎসার পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। সরকারি হাসপাতালের এই দুর্দশার সুযোগে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে ছুটছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। ফলে জমে উঠছে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে চিকিৎসা-ব্যবসা। সেখানে ডাক্তার নেই। নার্স নেই। প্যাথলজিস্ট নেই। এর পরও তারা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসা-ব্যবসা। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সার্ভিস চার্জের নামে রোগীদের কাছ থেকে আদায় করছে গলা কাটা ফি। সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিলেও নেই কোনো জবাবদিহি। এমনকি লাইসেন্সের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও নেই নবায়নের কোনো উদ্যোগ।

রাজধানীর তিনটি সরকারি হাসপাতাল, ৩৪টি সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শনের সরকারি প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এসব তথ্য। জানা যায়, জনগণের দীর্ঘদিনের নানা অভিযোগ আমলে নিয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন চায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে। ফলে মাঠে নেমে পড়েন কর্তারা। পরিদর্শক দলের চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে, যখন তারা বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন ডাক্তার নেই, নার্স নেই, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সুবিধা নেই। কিন্তু দিব্যি চলছে এসব ক্লিনিক। অনেকে ক্লিনিকের লাইসেন্সের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও নবায়ন না করেই চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। স্বাস্থ্য খাতের এই অরাজক অবস্থা দেখে স্বাস্থ্য অধিদফতর চারটি হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিল, ছয়টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করাসহ কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পরিদর্শক দল লাইসেন্সের শর্ত মোতাবেক প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সুবিধা ছাড়া ক্লিনিক পরিচালনার দায়ে মোহাম্মদপুরের ইসলামিয়া মানসিক হাসপাতাল, সেবা জেনারেল হাসপাতাল ও ফেমাস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করেছে। একই কারণে মোহাম্মদপুরের ঢাকা ল্যাব, মুন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লাইফ কেয়ার নার্সিং হোম অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এলিট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স,   ইজি লাইফ ফর বাংলাদেশ, সেবিকা জেনারেল হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া পরিদর্শক দল মুগদা ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখে, এসব হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ আইসিইউ, সিসিইউ, ডায়ালাইসিস বিভাগ রয়েছে। কিন্তু সেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও প্রশিক্ষিত নার্সের অভাব। আবার মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে তারা দেখতে পায়, সেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও প্রশিক্ষিত নার্সের কোনো সংকট নেই। তবে সেখানে কাজ করে না আইসিইউ/সিসিইউ বেডের মনিটর সিস্টেম। ডায়ালাইসিস মেশিন অচল। নেই উন্নত পরিবেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সুবিধায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কুর্মিটোলা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ১২ শয্যার আইসিইউ এবং ১৩ শয্যার এইচডিইউ বিভাগ চালু করা যাচ্ছে না ডাক্তার ও অ্যানেসথেটিস্ট না থাকায়। প্রতিবেদনে অবিলম্বে চারজন ডাক্তার ও দুজন অ্যানেসথেটিস্ট পদায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। একইভাবে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ডাক্তার, নার্স ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা সুসজ্জিত। চালুর পর থেকেই এখানে চিকিৎসা নিতে ছুটে আসছেন রোগীরা। এখানে আইসিইউ বিভাগে নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ না থাকায় চিকিৎসা প্রদানে সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে। এর পরও এখানে ১০টি আইসিইউ বেডে রোগী আছেন মাত্র পাঁচজন। ১০টি এনআইসিইউতে রোগী আছেন সাতজন। ১২টি সিসিইউর মধ্যে ১০টিতেই রোগীর চিকিৎসা চলছে। ডায়ালাইসিস বিভাগের ১৬টি বেডে চিকিৎসা চলছে আটজনের। প্রতিবেদনে এখানে নার্স সংকটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, পদায়নকৃত প্রশিক্ষিত নার্সদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া। মুগদা হাসপাতালের ঠিক উল্টো চিত্র পাওয়া গেছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে। এখানে অভিজ্ঞ ডাক্তার ও নার্সের অভাব নেই। তবে যন্ত্রপাতি পুরনো, মনিটর অকার্যকর, ডায়ালাইসিস মেশিন অচল। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিটফোর্ডে আইসিইউর বেড আছে আটটি। এর মধ্যে তিনটি বেডের মনিটর অকার্যকর। এখানে চিকিৎসাধীন রোগী আছেন চারজন। মিটফোর্ডের এনআইসিইউর বেড আছে ১৭টি। এর মধ্যে ছয়টি বেডের মনিটর অকার্যকর। চিকিৎসাধীন রোগী আটজন। তবে মিটফোর্ডের রোগীর চাপ বেশি সিসিইউ/পিসিইউ বিভাগে। এখানে বেড আছে ৩০টি। এর মধ্যে ১৮টি বেডের মনিটর অকার্যকর। এখানে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ৫২। এ ছাড়া মিটফোর্ডের ডায়ালাইসিস বিভাগের সাতটি মেশিনের মধ্যে অচল তিনটি। এ হাসপাতালের সব বিভাগের চিকিৎসার মান উন্নত করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর