শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শিশু নির্যাতনের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা

৯ মাসে ৩২৫ ধর্ষণ, ৫-১২ বয়সীদের বেশি নির্যাতন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ঘটেই চলেছে অপরাধ

জিন্নাতুন নূর

শিশু নির্যাতনের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা

কোমলমতি শিশুদের নিরাপত্তা কিছুতেই নিশ্চিত করতে পারছে না রাষ্ট্র ও অভিভাবকরা। শিশু নির্যাতন রোধে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও তাদের ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারছে না দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট মহল। দেশের ভবিষ্যৎ ফুলের মতো শিশুদের মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের যেখানে আগলে রাখার কথা, সেখানে এই সমাজেরই কিছু বিকৃত মনের মানুষ তাদের ওপর চালাচ্ছে জঘন্য নির্যাতন। এমনকি ঘৃণ্য এই অপরাধের হাত থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। দেশব্যাপী শিশুদের ওপর হওয়া নির্যাতনের ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু অপরিচিত ব্যক্তি নয়, পরিচিত, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীর দ্বারাও শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর যে ব্যক্তিরা শিশুদের ওপর এ ধরনের ঘৃণ্য নির্যাতন চালাচ্ছে তারাও কি ভিন্ন বয়সী— কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত। এদের কেউ শিশুদের জোর করে, কেউ খাওয়ার বা খেলনার প্রলোভন দেখিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে এ অত্যাচার চালাচ্ছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩২৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়; যার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ৪৮, যার ৩১ জন প্রতিবন্ধী, ৫ জন গৃহকর্মী। এর মধ্যে ১৫ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। আর এ সময় ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৫৪ শিশুকে। হিসাব বলছে, প্রতি মাসে গড়ে ৩৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষিতদের অধিকাংশের বয়স ৫ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশু অধিকার সুরক্ষায় আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। পথশিশুরা তো বটেই, এমনকি পরিবারের নিরাপদ গণ্ডির মধ্যে থেকেও শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদেরও এ নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দ্বারাও কোমলমতি শিশু নির্যাতিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের, ছেলেশিশুদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। মূলত এ বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারি এবং নির্যাতন রোধে দেশে প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োগ না থাকায় শিশুদের ওপর হওয়া এই নৃশংসতা রোধ করা যাচ্ছে না।

চলতি বছরের জুনে তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের দায়ে সিদ্দিকুর রহমান (৪২) নামে এক ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ঢাকার চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের  বিচারক সালেহ উদ্দিন আহমদ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে একই সঙ্গে ভিকটিমকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিচারক অপরাধীকে অর্থদণ্ড প্রদান করেন। ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল পাশের বাড়ির দারোয়ান সিদ্দিক শিশুটিকে তার বাসায় নিয়ে নির্যাতন করেন। এরপর ১৩ এপ্রিল শিশুটির বাবা মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। এই শিশুটির পরিবার বিচার পেলেও নির্যাতনের শিকার অন্য শিশুদের পরিবার তা পায় না। তারা মামলা করে বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতার জন্য বছরের পর বছর বিচারের প্রত্যাশায় থাকে। অনেককে আবার মামলা না করার জন্য হুমকি দেওয়া হয়। কেউ সামাজিকতার ভয়ে মামলাও করতে চায় না। ফলে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না। তারা একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। সাভারে গত মঙ্গলবার ১০ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ এখনো কাউকে আটক করতে পারেনি। সোমবার রাতে সাভারের আড়াপাড়া এলাকায় রতন নামে এক যুবক শিশুটিকে কৌশলে মোটরসাইকেলে করে একটি নার্সারিতে আটকে রেখে রাতভর নির্যাতন করে। মঙ্গলবার ভোরে নার্সারি থেকে গুরুতর অবস্থায় এক নারী তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিযে যান। এর আগে দিনাজপুরে ৫ বছরের এক শিশুকে প্রতিবেশী সাইফুল অমানবিক নির্যাতন করেন। নির্যাতনের শেষে শিশুটির মাথা ও গা থেঁতলে তার গায়ে সিগারেটের জ্বলন্ত ছেঁকা দেওয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যে রাজধানীতে পরপর আরও দুটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এদের একজন মিরপুরের ১২ বছরের এবং অন্যজন চকবাজারের ৭ বছরের মেয়েশিশু। এই শিশুদের দুজনই গৃহকর্মী। নির্যাতনের শিকার শিশুদের ঢামেক হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে। জানা যায়, মিরপুরের শিশুটিকে সে যে বাড়িতে কাজ করত সেই ভবনের নিচতলার গাড়ি রাখার স্থানে সাগর নামে এক গাড়িচালক নির্যাতন করেন। আর চকবাজারের শিশুটিকে নির্যাতন করেন সে যে বাড়িতে কাজ করত তার গৃহকর্তা জয়নাল। পুলিশ জয়নালকে আটক করেছে। ওপরের ঘটনাগুলো ছাড়াও রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিনিয়তই শিশু-কিশোররা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও বেশির ভাগই গোপন থেকে যাচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা জানান, যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুরা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে বড় হয়। তাদের আত্মবিশ্বাস কম থাকে। তারা কথা বলা কমিয়ে দেয়। শারীরিকভাবেও এই শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারও গোপনাঙ্গে সংক্রামক রোগ দেখা দেয়। যোনিপথ ও পায়ুপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক শিশুর অভিভাবকরা মনে করেন, এ ঘটনার ফলে কন্যাশিশুটির ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রতিবেশী ও পরিচিতজনদের কাছে সামাজিকভাবেও তাদের হেয় হতে হবে এমন চিন্তা থেকে অনেকে বিষয়টি সামনে আসতে দেন না। এ ছাড়া দরিদ্রদের অনেকে আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় মামলা আর চালাতে পারেন না। সাক্ষীর অভাবে অনেকে বিচার পান না। অন্যদিকে অপসংস্কৃতি ও প্রযুক্তির কারণে আজকাল পর্নো ছবি ও অশ্লীল চলচ্চিত্রও শিশুদের ওপর হওয়া এই ভয়াবহ নির্যাতনকে উসকে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি দৌলতদিয়া পতিতালয়ে জোরপূর্বকভাবে কন্যাশিশুদের পতিতা বানানো হচ্ছে। বিশেষ করে ফরিদপুরের একটি পতিতালয়ে ১০ থেকে ১৫ বছরের মেয়েদের জোরপূর্বক পতিতা বানানো হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট কাজ করছে। এলাকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, চেয়ারম্যান অর্থাৎ স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

নির্যাতনের কারণ : বিশেষজ্ঞরা জানান, শিশুদের ওপর জোর খাটানো সহজ। এমনকি তাদের ভয় দেখিয়ে এ সম্পর্কে কাউকে না জানানোর জন্যও অপরাধীরা হুমকি দেয়। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিশুরা অভাবের কারণে সচ্ছল পরিবারের গৃহকর্মীর কাজে নিযুক্ত হয়। কিন্তু সেখানে শিশুটির দেখভালের জন্য কেউ নেই। এ সুযোগে সেই পরিবার বা তার আশপাশের বিকৃত রুচির কিছু মানুষ শিশুটির ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সাধারণত ধর্ষণের মামলায় সাক্ষ্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের সন্নিবেশ ঘটাতে গিয়ে এসব মামলার দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে এ মামলাগুলো চলতেই থাকে। আর নির্যাতনকারী কোনোভাবে আটক হলেও মামলা তুলে নেওয়ার জন্য প্রভাবশালী মহল থেকে হুমকি বা অর্থের প্রস্তাব দেওয়া হয়। শিশুদের সুরক্ষায় মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, গ্রাম্য আদালত ও স্থানীয় সরকারকে এ বিষয়ে সক্রিয় থাকতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বা চেয়ারম্যানকে সচেতন থাকতে হবে। এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হ।

সর্বশেষ খবর