রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কর ফাঁকির শীর্ষে পেশাজীবীরা

রুহুল আমিন রাসেল

কর ফাঁকির শীর্ষে পেশাজীবীরা

দেশে আয়কর ফাঁকিতে একাট্টা আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ নানা ধরনের পেশাজীবী। তাদের মধ্যে ব্যাংকাররা কিছুটা স্বচ্ছ করদাতা হলেও আয়কর ফাঁকির শীর্ষে আছেন আইনজীবী ও শিক্ষকরা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন তারা। তাদের আর্থিক লেনদেনের ক্যাশমেমো বা চালানপত্র না থাকায় কর ফাঁকি বাড়ছেই। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন বিচ্ছিন্নভাবে দেশের ৬৪৯টি কর সার্কেল অফিস বছরে কমপেক্ষ ৫০ হাজার পেশাজীবীর আয়কর ফাঁকি দেওয়ার তথ্য উদ্ঘাটন করছে। এ প্রসঙ্গে সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আয়ের উৎস পেশাজীবীরা প্রকাশ করতে চান না। সরকার চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করে দিলেও তারা বেশি নেন। কিন্তু প্রকাশ করেন না। একইভাবে আইনজীবীরা তাদের মক্কেলের কাছ থেকে কত টাকা নেন এরও হিসাব অন্য কেউ রাখে না। শিক্ষকরা স্কুল-কলেজের বাইরে প্রাইভেট পড়ালেও নৈতিকতা দেখিয়ে তা প্রকাশ করেন না। এক কথায়, আইনজীবী ও শিক্ষকদের ফিতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি তাদের লেনদেনের কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়াও নেই।

প্রসঙ্গত, কর বা আয়কর হলো বার্ষিক আয়ের ভিত্তিতে আদায়যোগ্য করের নাম। এটি নাগরিকের আয় ও সম্পদের ভিত্তিতে আদায় করা সরকারের রাজস্ব। নাগরিক তার ওপর ধার্য করা কর সরকারি কোষাগারে জমা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এনবিআর এই কর আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কর ফাঁকির রেকর্ড পরিমাণ তথ্য পেয়েছে এনবিআর। কর ফাঁকির এ তালিকায় আছেন আইনজীবী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও শিক্ষক। এ ছাড়া সুশীল পেশাজীবীদের সঙ্গে আছেন রাজনীতিকরা। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের আয়কর ফাঁকির পাহাড়সম তথ্য জমেছে এনবিআরে। জানা গেছে, দেশে কর ফাঁকির অধিকাংশ তথ্য জমা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এ তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এনবিআরের কাছে নথি তলব করে দুদক। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না কর ফাঁকি। বর্তমানে উচ্চ আদালতে চলমান ২৫ হাজার মামলায় যে ৩১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আটকে আছে, এর অধিকাংশ আয়কর ফাঁকি-সংক্রান্ত। তবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ে এনবিআর যতটা সক্রিয়, ততটাই নিষ্ক্রিয় পেশাজীবীদের কাছ থেকে আদায়ে। ফলে দেশে লাখ লাখ পেশাজীবী এখনো আয়করের আওতায় আসেনি। তাদের নেই করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা ই-টিআইএন। এমনকি দেশে কতজন পেশাজীবী করদাতা আছেন, কোন পেশার করদাতা কী পরিমাণ আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছেন, এরও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি কর প্রশাসন। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ) আবদুর রাজ্জাক বলেন, এনবিআর এখনো পুরোপুরি কম্পিউটারাইজ না হওয়ায় পেশাভিত্তিক আয়কর রিটার্ন দাখিল ও কর আদায়ের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে পেশাজীবীদের যে হারে এগিয়ে এসে আয়কর রিটার্ন দাখিল ও কর দেওয়ার কথা, সে হারে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মতে, শতভাগ শিক্ষককে করের আওতায় আনা উচিত হলেও তারা আসছেন না। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর কমপক্ষে ১৬ হাজার টাকা যাদের আয়, তাদের সবাইকে রিটার্ন জমা দিতে হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ, মেডিকেল কলেজের শিক্ষকের আয় এ ক্ষেত্রে করযোগ্য। এ সংখ্যা পাঁচ লাখ হলেও তাদের এক লাখও কর দেন না।  তিনি বলেন, ‘আইন একটা পেশা। সারা দেশে দেড় থেকে দুই লাখ আইনজীবী আছেন। অথচ ৫০ হাজার আইনজীবীও আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। আমি মনে করি, যে কোনো আইনজীবী, যিনি ছয় মাস থেকে এক বছর পেশায় আছেন, তারও আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া উচিত। দেশে নিবন্ধিত আইনজীবী ও কর উপদেষ্টাদের সংখ্যা যদি পাঁচ লাখ হয়, এর মধ্যে সাড়ে ৪ লাখের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া উচিত।’ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেনের ‘বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের আকার ও প্রবৃদ্ধি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল এই ২০ বছরে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত হয়েছে ২০ শতাংশ মানুষ। মধ্যবিত্তদের ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি চাকরি করেন। আবার ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করেন। তবে প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করেন। গত দুই দশকে মধ্যবিত্ত জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৩ সালে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে দেশে যে হারে মধ্যবিত্ত পেশাজীবী বাড়ছে, সে হারে সরকার আয়কর পাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এনবিআরের দায়িত্বশীল শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের মতে, স্বচ্ছ লেনদেন ও রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা না থাকায় কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন পেশাজীবীরাও। দেশে কোটি টাকা ব্যাংক-হিসাবধারীর সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। এটি দুই বছর আগে ছিল ৫১ হাজার ৫৫০। যদিও ১৯৭৫ সালেও কোটি টাকার বেশি এমন হিসাবের সংখ্যা ছিল ৪৭টি। তবে এ হিসাব কোটিপতির সংখ্যার প্রকৃত হিসাব নয়। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রকৃত কোটিপতির সঠিক হিসাব প্রকাশ করে না। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুতগতিতে বাড়ছে কোটিপতি। এর সঙ্গে প্রত্যাশিত সুশাসনের অভাবে বাড়ছে কর ফাঁকিও। এতে উচ্চবিত্তদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মধ্যবিত্তরা। উন্নয়নশীল এই বাংলাদেশে কর ফাঁকি দেওয়া অর্থের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা নিরাপদে পাচার হচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে। এমন কর ফাঁকিবাজদের ভয়ের প্রতীক হিসেবে ‘বাঘের চেহারা’ দেখানোর ঘোষণা এনবিআর দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না কেউ। জানা গেছে, জলুাই থেকে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২১ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর বেতন বেড়েছে। গ্রেডভেদে মূল বেতন ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বাড়ে। নতুন স্কেলে প্রথম গ্রেডে সর্বোচ্চ মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা হলেও ২০তম গ্রেডে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা। এখন সরকারি চাকুরেরা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন ৪ হাজার ১০০ টাকা মূল বেতন পান। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্য, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) পাওয়া শিক্ষক, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নতুন জাতীয় বেতন ১ জুলাই থেকে পাচ্ছেন। একই সঙ্গে স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ক্ষেত্রেও নতুন বেতন স্কেল প্রযোজ্য রয়েছে। একই সঙ্গে চালু হয়েছে নববর্ষ ভাতা। এরপর সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি চাকরিরত পেশাজীবীসহ যাদের মাসিক আয়ে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা, তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে। তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ করবর্ষে কোনো ব্যক্তির বার্ষিক আয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে তাকে কর দিতে হবে। তবে নারী এবং ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব প্রবীণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পৌনে চার লাখ টাকা এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সোয়া চার লাখ টাকা। এ ছাড়া সন্তান প্রতিবন্ধী হলে পিতা-মাতা ও আইনানুগ অভিভাবক আরও ২৫ হাজার টাকা করমুক্ত সুবিধা পাবেন। চলতি অর্থবছরের বাজেটে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে প্রতিবছর ৩০ নভেম্বরের পর আয়কর রিটার্ন জমা নেওয়া হবে না। তবে ৩০ নভেম্বর যদি সরকারি ছুটি থাকে, তাহলে পরবর্তী খোলার দিনই হবে জাতীয় আয়কর দিবস। এদিন কোনো করদাতা রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হলে তাকে গুনতে হবে জরিমানা। এনবিআর জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর যাদের মাসিক মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা বা তার বেশি, তাদের করদাতা শনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) থাকা এবং বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। আগের তিন বছরের আয় যদি করযোগ্য হয়, তাহলে এবারও রিটার্ন দিতে হবে। যাদের ব্যবসা বা পেশা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, তাদেরও বিবরণী দাখিল করতে হবে। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত সব এনজিওকে তাদের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে। ডাক্তার, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, আয়কর আইনজীবী, চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট, কস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার অথবা এ ধরনের পেশায় নিয়োজিত সবাইকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বা ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সব সদস্যের আয়কর বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, বিভাগীয় শহর বা জেলা শহরে বসবাসকারী কেউ গাড়ির মালিক হলে কিংবা মূল্য সংযোগ কর আইনে নিবন্ধিত কোনো লিমিটেড ক্লাবের সদস্য হলে তাকেও রিটার্ন দিতে হবে। পৌরসভা, সিটি করপোরেশন বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রার্থীকে তাদের হিসাব বিবরণী দাখিল করতে হবে।

সর্বশেষ খবর