বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে পাঁচটি ঝুঁকি দেখছে বিশ্বব্যাংক। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারকে কিছু পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি। ঝুঁকিগুলো হলো—বিনিয়োগে দীর্ঘায়িত মন্দা পরিস্থিতি, ব্যবসার পরিবেশ উন্নত না হওয়া, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মানে অবনমন এবং বহির্বিশ্বে নতুন রপ্তানি ও শ্রমবাজার অনুসন্ধান করা। ৩ অক্টোবর প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারলে চলতি অর্থবছর শেষে বাজেটের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। তবে ওই প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ছয় থেকে সাত বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। অবকাঠামো সমস্যা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট এবং ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দেওয়ায় বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ছে না। ফলে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারি খাতের বিনিয়োগকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ খাতের বিনিয়োগ ২৯ শতাংশে উন্নীত করতে কিছু কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হচ্ছে। এদিকে গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও আস্থাহীনতা কাটাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে না পারায় ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ মোট জিডিপির গত তিন বছরে সর্বনিম্ন ২১ দশমিক ৮ শতাংশে অবস্থান করছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করছে। ফলে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমেছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, সেপ্টেম্বর শেষেও রেমিট্যান্সের প্রবাহে নেতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নতুন বাজার অনুসন্ধান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য রপ্তানির নতুন বাজারও অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি বৃদ্ধি আর্থিক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে না পারায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, দেশে কেউ ব্যবসা শুরু করতে চাইলে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা পার করে ব্যবসা শুরু করতে অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসার প্রারম্ভিক ব্যয় এখনো বাংলাদেশে বেশি। এতে একটি ব্যবসার অনুমতি পেতে সময় লাগে ২৭৮ দিন। আবেদনের পর একটি বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে সময় লাগে ৪০৪ দিন, যেখানে ভারতে আবেদনের মাত্র ৪৭ দিনের মাথায় বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়ে যান ব্যবসায়ীরা। রেজিস্ট্রেশন পেতে সময় লাগে ২৪৪ দিন। সবকিছু গুছিয়ে আনার পরও ব্যবসা শুরু করতে সময় লাগে আরও ১৯ দিন, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় এসব ক্ষেত্রে মাত্র চার দিন সময়ের প্রয়োজন হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ (ঢাকা) ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে পারলে বাংলাদেশ উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির ঝুঁকিগুলো অনেকটা ঢেকে ফেলতে সক্ষম বলে তিনি মনে করেন।