মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নীরব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

স্টেশনারি অফিসে লুটপাটের উৎসব

বিদেশি কাগজ কেনার নামে দেশি শিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের রহস্যজনক নীরবতায় ফ্রি-স্টাইলে কোটি কোটি টাকা লুটপাট চলছে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসে। বিদেশি কাগজ কেনার নামে বিশ্বমানের দেশীয় উন্নত কাগজশিল্প ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত চক্রান্তকারীদের সঙ্গে আঁতাত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা স্টেশনারি অফিসের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, ‘এ-ফোর’ সাইজের সাদা অফসেট বিদেশি যে কাগজ খোলা বাজারে প্রতি রিম ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়, তা ৪২৯ টাকায় কিনতে যাচ্ছে স্টেশনারি অফিস। যদিও দেশে উৎপাদিত একই মানের খুব ভালো ব্র্যান্ডের কাগজ প্রতি রিম বিক্রি হয় ২৫০ টাকায়। আর এভাবেই একদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট, অন্যদিকে বিশ্বমানের উন্নত কাগজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশীয় শিল্প ধ্বংসের চক্রান্তকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে স্টেশনারি অফিস।

সূত্রমতে, স্টেশনারি অফিস প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম ভাঙিয়ে বিদেশি কাগজ কিনতে যাচ্ছে। বিদেশি কাগজের শর্তারোপ করে দুটি টেন্ডারও (দরপত্র) আহ্বান করেছে স্টেশনারি অফিস। প্রতিষ্ঠানটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা স্থানীয় এজেন্টদের সঙ্গে যোগসাজশে বিদেশি কাগজ কেনায় অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করছে বলে সূত্র জানায়। আর এই প্রক্রিয়াতে সরকারের ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা লুটপাটের আয়োজন করা হয়েছে। আর এ সুদূরপ্রসারী অসৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্টেশনারি অফিস কর্তৃপক্ষ কাগজ কেনার প্রক্রিয়াটি ই-টেন্ডারের আওতায় করেনি। ই-টেন্ডারের মাধ্যমে এই কাগজ কেনা হলে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারত। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্তমানে একই মালিকানার পৃথক নামের দুটি প্রতিষ্ঠান এম এইচ এন্টারপ্রাইজ এবং এফ এফ এন্টারপ্রাইজ এই টেন্ডারে অংশ নিয়েছে। জানা গেছে, আমদানি নীতি অনুযায়ী পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন—বিএসটিআইর অনুমোদন ছাড়া কোনো পণ্য সাদা কাগজ আমদানি ও বাজারজাত করা নিষিদ্ধ। তারপরও সরকারি দফতর স্টেশনারি অফিস কর্তৃপক্ষ এই নীতির তোয়াক্কা না করে বেআইনিভাবে বিদেশি কাগজ কিনছে। এ ক্ষেত্রে একটি মহল নিজেদের হীনস্বার্থে কোনো আইন মানছে না। এমন প্রেক্ষাপটে দেশীয় কাগজশিল্প উদ্যোক্তারা মনে করেন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর যথাযথ নজরদারি প্রয়োজন স্টেশনারি অফিসের কর্মকর্তাদের ওপর। তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য উন্নতমানের ‘এ-ফোর’ সাইজের সাদা অফসেট বিদেশি কাগজ কিনতে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস। প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক মো. হামিদুল হক গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১ লাখ ৫০ হাজার রিম বিদেশি ‘ডাবল-এ’ বা সমমনা ব্র্যান্ডের কাগজ রাজস্ব খাতের অর্থায়নে কেনা হবে। পরের দিন গত ২৬ সেপ্টেম্বর আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়—আরও ২০ হাজার রিম বিদেশি ‘ডাবল-এ’ বা সমমান ব্র্যান্ডের কাগজ কেনা হবে। জানা গেছে, দেশে যে পরিমাণ কাগজের চাহিদা রয়েছে, তার দ্বিগুণের বেশি উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে দেশীয় কাগজ মিলগুলোর। উৎপাদিত কাগজ বিশ্বমানের হওয়ায় রপ্তানিও হচ্ছে। তবুও আমদানি করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বিদেশি কাগজ। দেশীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি করা বেশির ভাগ কাগজই নিম্নমানের। অথচ দেশে উৎপাদিত উন্নতমানের কাগজ কিনছে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, টাকশাল, পাঠ্যপ্রস্তক বোর্ড, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহ। সেখানে সরকারের স্টেশনারি অফিস বিদেশি কাগজ কেনার উদ্যোগে স্থানীয় বিকাশমান কাগজশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের উপ-পরিচালক মো. হামিদুল হক গত ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে মন্ত্রণালয়ের ব্র্যান্ডিং চাহিদা থাকে কিছু। তারা ‘ডাবল-এ বা পেপার ওয়ান’ নামের কাগজ চায়। আমরা নিজের চাহিদায় কোনো কাগজ কিনি না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলে দেয় যে, ডাবল-এ বা পেপার ওয়ান কাগজ লাগবে। আমিও জানি দেশে অনেক ভালো কাগজ তৈরি হয়। আমরা এর আগেও কিনেছি। দেশে অনেক ভালো ভালো ব্র্যান্ডের কাগজ আছে। কিন্তু আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আমরা তো অন্যের চাহিদার ভিত্তিতে কিনি, এটাই হচ্ছে সমস্যা। তবে বাংলাদেশ পেপার মিলস এসোসিয়েশন-বিপিএমএর সচিব এ কে এম. নওশেরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের কাগজশিল্প এখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত। ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে শতাধিক কারখানা আছে। এই কারখানাগুলো বছরে ১৪ লাখ টন কাগজ উৎপাদনে সক্ষম। দেশে উৎপাদিত সব ধরনের কাগজই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এমনকী দেশের পুরো চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আমাদের সদস্য কারখানাগুলো বিশ্বের ২৫ থেকে ৩০টি দেশে বিভিন্ন জাতীয় কাগজ ও কাগজজাত পণ্য রপ্তানি করছে। তারপরও যেখানে সরকার দেশীয় শিল্প সুরক্ষার চিন্তা করছে, সেখানে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস কী উদ্দেশ্যে বিদেশি কাগজ আমদানি উৎসাহিত করতে তাদের টেন্ডার (দরপত্র) আহ্বান করেছে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমাদের মনে হয়, এমন কর্মকাণ্ড কিছুটা উদ্দেশ্যমূলক। কারণ, আমরা যে মেশিন ও উপকরণ বা কাঁচামাল দিয়ে কাগজ উৎপাদন করি, বিদেশিরাও তাই করে। সব মিলিয়ে আমাদের দেশে উৎপাদিত কাগজ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি কাগজের চেয়েও উন্নত মানের কাগজ আমরা উৎপাদন করি। সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন-সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ, ব্রিটিশ-আমেরিকান ট্যোবাকো, ইউনিলিভার, বিভিন্ন দূতাবাসও আমাদের দেশীয় কাগজ কিনছে। সেখানে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি কাগজ প্রোমোট (উৎসাহিত) করছে, এটা আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়। সরকার যেখানে শিল্পায়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে কাজ করছে, সেখানে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করার একটি প্রচেষ্টা রহস্যজনক। তারপরও আমরা আশা করব, ওই প্রতিষ্ঠানটি কোনো সুনির্দিষ্ট বিদেশি কাগজ উল্লেখ না করে, দেশি-বিদেশি সবাইকে সমান সুযোগ দেবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর