শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি

♦অপরিকল্পিত শিল্প বাড়িঘর, নগরায়ণ ♦ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ইটভাটায় ♦সরকারি প্রকল্পও ফসলি জমিতে ♦পুকুর খনন মাছ চাষ নদী ভাঙনেও হারাচ্ছে

সাঈদুর রহমান রিমন

হারিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি

বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা নির্মাণে ব্যবহারের কারণে প্রতিদিনই কমছে কৃষি জমি। দিনে দুই হাজার বিঘা জমি কৃষি থেকে অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। একইভাবে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন ৯৬ বিঘা জলাভূমি। সেসব জলাভূমিও ভরাট করে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তামাক ও চিংড়ি চাষের ফলে প্রতি বছর ২৪ হাজার বিঘা জমি কৃষি কাজের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, নগরায়ণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, পুকুর খনন, মাছ চাষ ও নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। আবার নগদ টাকার লোভে জমি বিক্রি করে বাস্তুহারা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১১ বছরে ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়ায় কমে গেছে ধান চাষ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট তাদের সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশে মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে ৬৬.৬ শতাংশ জমি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দেশে কৃষি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলায় কৃষি জমির বাণিজ্যিক ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। রাজশাহী, নাটোর, রাঙামাটি ও হবিগঞ্জ বাণিজ্যিকভাবে কৃষি জমি ব্যবহারে মধ্যম অবস্থানে রয়েছে। আর কৃষি জমির বাণিজ্যিক ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম সাতক্ষীরা, বরিশাল ও নেত্রকোনায়। তবে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াকেই ‘ফসলি জমি হারানোর’ প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। পরিকল্পনাহীন নগরায়ণের ছোবলে বৈচিত্র্যও হারাচ্ছে কৃষি। ইটভাটার জন্যও প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকায় ধানের জমিতে বাঁধ দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। কোথাও কোথাও হচ্ছে লবণের উৎপাদন। নানাভাবে কৃষি জমি অনুৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে ব্যবহার চলছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দশকে দেশে কৃষি জমির ব্যাপক সংকটের হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্ট সব গবেষণার ফলাফলেই কৃষি জমি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া এবং অচিরেই বিপন্নতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিপন্নতা মোকাবিলায় সরকারের কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নেই। নেই আধুনিক বাস্তবসম্মত কোনো আইন। স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজন পড়ছে। তার প্রভাব পড়ছে ফসলি জমির ওপর। পরিবার বিভক্ত হলে তার প্রথম ধকলটিই পড়ে কৃষি জমিতে। এক বাবার চার সন্তান পৃথক হওয়ার পরক্ষণেই আবাদি জমিতে যার যার বাড়িঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ দেখা যায়। অনেকে চাকরির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি জমির কোনো প্রয়োজনবোধ করছেন না। এর পরও আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল। প্রতি বছর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে সহস্রাধিক হেক্টর জমি। আবাসন ও নির্মাণকাজে চলে যাচ্ছে কমবেশি আরও তিন হাজার হেক্টর। গত ৩৭ বছরে শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে ৬৫ হাজার একর কৃষি জমিতে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমছে, তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে ৬৫ শতাংশ জমির উর্বরা শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এখনই কৃষি জমি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। বিআইডিএসের গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘কৃষি জমি কমে গিয়ে অনুৎপাদন খাতে চলে যেতে থাকলে জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কৃষি খাতে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে।’

সরকারি উদ্যোগেও কমছে কৃষি জমি: শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে তা নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কারণেও কমছে কৃষি জমি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও এলএনজি টার্মিনাল, এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, সাগরে জ্বালানি তেলের ভাসমান ডিপো ও পাইপলাইন (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) স্থাপন বাবদ আরও প্রায় ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত রয়েছে। কৃষি জমি যে কেউ যে কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারেন। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই। এজন্য আইন পরিবর্তন করে উর্বর ও কৃষি উপযোগী জমির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বার বার বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো বিধিবিধান এ পর্যন্ত করা যায়নি। ‘জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি-২০১০’ এবং ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন-২০১০’ অনুযায়ী কৃষি জমি কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কৃষি জমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না উল্লেখ করে একটি নামমাত্র আইন থাকলেও এর শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

ইটভাটা : গ্রামাঞ্চলে কৃষি জমির সবচেয়ে বড় সর্বনাশ ঘটাচ্ছে ইটভাটাগুলো। ৮ থেকে ১০ একর জমি ধ্বংস করেই এসব ইটভাটা গড়ে ওঠে। ইটভাটার জন্য মাটিও কেটে নেওয়া হয় আবাদি জমি থেকে। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবে ইটখোলা আছে ৪ হাজার ৫১০টি। তবে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ইটখোলার সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। এসব ইটখোলায় বছরে অন্তত সাড়ে ১৩ কোটি টন মাটি লাগে, যে কারণে বছরে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমি ২ ফুট গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নেওয়া হয়। সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় মাছ চাষ একটি বৃহত্তম কৃষিভিত্তিক খামারে পরিণত হয়েছে। মাছের এ খামারগুলো গড়ে উঠেছে কৃষি জমিতে। বিভিন্ন জেলা শহরের আশপাশে যত্রতত্র গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্পসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ঢাকার আশপাশের ভূমির চিত্র ঠিক একই রকমের। যাত্রাবাড়ী-ডেমরা-আশুলিয়াসহ আশপাশের এলাকায় রয়েছে বিশাল বিশাল জলাশয়সহ কৃষি জমি। মাটি দিয়ে নির্বিচারে ভরাট করা হচ্ছে এসব জমি। অনেক জমি কেনার পর বাউন্ডারি করে রাখা হয়েছে।

কৃষি জমির হালচাল : ভূমি জরিপ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১ সালে দেশে আবাদি জমি দুই কোটি ১৭ লাখ হেক্টর; যা ১৯৮৬ সালে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে এবং ২০০৩ সালে আরও কমে দাঁড়ায় ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে। ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ। ২০০০ সালে ১৩ কোটি এবং বর্তমানে ১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত ২০ বছরে গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখই দরিদ্র। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ১১ কোটিই গ্রামে বাস করে। একটি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগওয়ারি অকৃষি খাতে জমি চলে যাওয়ার প্রবণতা চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি। এখানে প্রতি বছর ১৭ হাজার ৯৬৮ হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ১৫ হাজার ৯৪৫, ঢাকায় ১৫ হাজার ১৩১, খুলনায় ১১ হাজার ৯৬, রংপুরে ৮ হাজার ৭৮১, বরিশালে ৬ হাজার ৬৬১ হেক্টর প্রতি বছর অকৃষি জমিতে পরিণত হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর