শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর

জুন্নু রায়হান, ভোলা

আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনে শতাব্দীর মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলসহ ভোলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছিল ১০ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ। ’৭০-এর সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন এবং আজও সেই ভয়াল দিনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন ওই বিভীষিকাময় দিনের কথা মনে পড়লেই তারা আঁতকে ওঠেন। 

ওই ভয়াল ১২ নভেম্বর স্মরণে ভোলায় বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা সভা, সেমিনার, কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন। ধারণা করা হয় প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগে দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এর মধ্যে ভোলা জেলায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। আর অসংখ্য জনপদ বিরান হয়েছে। উত্তাল মেঘনা নদী আর তার শাখা প্রশাখাগুলোতে দেখা গেছে লাশ আর লাশ। কচুরি পানার মতো লাশ ভাসতে দেখা গেছে বিভিন্ন খাল আর নদীতে। গরু-ছাগল আর মানুষকে একই গর্তে মাটিচাপা দিতে হয়েছে। কোথায় জানাজা আর কে করে কার সৎকার! প্রত্যক্ষদর্শী ভোলার স্থানীয় দৈনিক বাংলার কণ্ঠের সম্পাদক ভোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এম হাবিবুর রহমান বলেন, ১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর বুধবার সকাল থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। পরদিন ১২ নভেম্বর আবহাওয়া আরও খারাপ হতে লাগল, বাতাসের বেগ আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে এবং মাঝরাত থেকেই ফুঁসে উঠতে লাগল সমুদ্র। তীব্র বেগে ধেয়ে আসল পাহাড় সমান সমুদ্রের ঢেউ। ভোর রাতের দিকে সদর উপজেলার ওয়াবদার ১৪ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধ ডিঙ্গিয়ে আছড়ে পড়ল বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার পানি জনবসতির ওপর। মুহূর্তের মধ্যে খড় কুটার মতো, কাগজের তৈরি নৌকার মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল মানুষ, গবাদিপশুসহ বাড়িঘর। পর দিন দেখা গেল সোনালি ফসলের খেত আর মেঘনা তেঁতুলিয়াসহ বিভিন্ন খাল-বিল, পুকুর, ডোবা-নালা সর্বত্রই লাশ আর লাশ। শিয়াল আর শকুনে কত যে লাশ খেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া বর্তমানে ভোলা শহরের কালীবাড়ি সড়কের বাসিন্দা বৃদ্ধা আলমগীরের মা জানান, তখন তার সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে দৌলতখানের মদনপুর ইউনিয়নে (বর্তমানে তা মেঘনার গর্ভে বিলীন)। কোলে মাত্র দেড় মাসের এক ছেলে সন্তান। রমজান মাস। আগের দিন থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ভোর রাতে সাহরি খেতে কেউ ওঠেনি। হঠাৎ বাড়ির কে যেন চিৎকার করে উঠল পানি আইতাছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রবল স্রোতের তোড়ে কে কোথায় ভেসে গেছে কেউ জানে না। পানি আর পানি। বড় বড় নারিকেল গাছের মাথার ওপর দিয়ে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এটুকু মনে আছে। আর কিছুই মনে নেই। যখন তার হুঁশ হলো তিনি দেখেন একটি বড় রেইন্ট্রি গাছের দুটি ডালের মাঝে তিনি আটকে আছেন। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। দেখলেন বেঁচে আছেন। পানি কমেছে তবে তখনো নিচে অনেক পানি। চার দিকে দিনের আলো। তবে সূর্য দেখা যাচ্ছে না। তিনি দেখেন একই গাছে সাপ, পাখি আর নানা ধরনের কীটপতঙ্গের সঙ্গে তিনি বসে আছেন। তার গায়ে ঘাড়ে মাথায় পাখি সাপ আর পোকামাকড় উঠছে নামছে। কেউ কাউকে আঘাত করছে না। সারা দিন সেখানে আটকে থাকার পর সন্ধ্যার কিছু আগে অপরিচিত লোকজন তাকে দেখতে পেয়ে নামিয়ে আনেন। তার শ্বশুর বাড়ির ৪০/৫০ জন মানুষের মধ্যে দু-চার জন ছাড়া সবাই মারা গেছে ওই বন্যায়।

 

নোয়াখালী সংবাদদাতা জানান, ১৯৭০ সালের এদিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নেয় দেশের উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীর হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জের লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ। এক এক করে ৪৬ বছর কেটে গেলেও আজও কান্না থামেনি স্বজনদের। জলোচ্ছ্বাসে কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, মারা যায় অগণিত পশু। সেই দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে অরক্ষিত বিভিন্ন চর ও দ্বীপে বাস করছে প্রায় ৫ লাখ মানুষ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তাদের আশ্রয়ের জন্য নেই পর্যাপ্ত আয়োজন। বিশাল ম্যানগ্রোভ বন প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করত, তাও অনেক আগেই বিরান হয়ে গেছে। ২০-২৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস থেকে সেদিন যারা প্রাণে বেেঁচ যান তাদের স্মৃতিতে সেই দুঃস্বপ্নের দিনটি আজও ভেসে ওঠে। জেলার উপকূলজুড়ে তখন ছিল নতুন ফসল কাটার মৌসুম। প্রকৃতির কাছে আজও অসহায় উপকূলের মানুষ। ১২ নভেম্বরের দিনটিতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সারা দিন রোজা রেখে ক্লান্ত মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখনই আঘাত হানে ভয়ঙ্কর এক ঘূর্ণিঝড়। গভীর রাতে সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষ, ঘরবাড়ি ও গবাদিপশুগুলো।

আমতলী প্রতিনিধি জানান, সেই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলের জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ভোলা, বরিশালের জনজীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। এতে প্রাণহানি ঘটে ৩ লক্ষাধিক মানুষের। অগণিত গবাদিপশু মারা যায়। হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে পড়ে। সেই রাতের বিভীষিকাময় স্মৃতি এ অঞ্চলের স্বজনহারা পরিবারগুলোকে আজও ব্যথিত করে। সেদিনের ‘গোর্কি’র তীব্রতা ছিল ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার, সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চলের পানি বাড়তে বাড়তে গোটা এলাকা প্লাবিত হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর