মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিমানে নিয়োগ কেলেঙ্কারি

মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করলেও নিয়োগ নিশ্চিত, বেরিয়ে আসছে মহা দুর্নীতির নানা কাহিনী

মির্জা মেহেদী তমাল

বিমানে নিয়োগ কেলেঙ্কারি

বিমানের ট্রাফিক হেলপার পদে লোক নেওয়া হবে ৬০ জন। এ জন্য নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার। কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন মাত্র ৪৬ জন। এখনো বাকি মৌখিক পরীক্ষা। প্রশ্ন উঠেছে, মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়লে পদ পূরণ হবে কোন উপায়ে? এমন প্রশ্নের জবাব বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তবে অনেকেই বলছেন, মোখিক পরীক্ষায় পাস-ফেল যাই করুক না কেন, তাদের প্রত্যেককেই নিয়োগ দিয়ে দেওয়া হবে। এরপরও বাকি থাকে ১৪ জন। পরীক্ষার আগেই এই ১৪ জনকেও ঠিক করে রেখেছে সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাফিক হেলপার নিয়োগ নিয়ে বিমানের দুর্নীতি অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিমানের ভিতর-বাইরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। মোটা অঙ্কের টাকায় তাদের ম্যানেজ যারা করেছেন, তাদেরই পাস করানো হয়েছে। যারা ম্যানেজ করতে পারবে-বাকি ১৪ পদও তাদেরই হবে। এমন সমীকরণে সিন্ডিকেট যখন খুবই তত্পর তখনই ফাঁস হয় মহাদুর্নীতির নানা কাহিনী। কেলেঙ্কারিতে নিয়োগ প্রক্রিয়াই এখন ঝুলে গেছে।

জানা গেছে, বিমানের রয়েছে বিশ্বমানের একটি ট্রেনিং  সেন্টার-বিএটিসি। চার দশক ধরে বিমান অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে নিজস্ব জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করে আসছে। অথচ বর্তমান পর্ষদের আমলে নিয়োগ পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে দিয়ে নেওয়া হয়।

এমন নজিরবিহীন কেলেঙ্কারিতে বিমানে দেখা দিয়েছে চরম  ক্ষোভ ও অসন্তোষ। আরেক পদের ক্ষুব্ধ একজন প্রার্থী  গোলাম মস্তফা আদালতের আশ্রয় নিয়ে বিমানকে উকিল নোটিস দিয়েছেন।

বিমান সূত্রগুলো জানায়, নিয়োগের এমন চিত্র শুধু ট্রাফিক  হেলপার পদের ক্ষেত্রেই নয়, ট্রাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট, জুনিয়র মেকানিক্যাল, জুনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান ও সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের নিয়োগেও একই চিত্র। যে কারণে বিমানের পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় চরম বিতর্কের মুখে পড়েছে বিমান ব্যবস্থাপনা বিভাগ। শুধু ব্যবস্থানা বিভাগই নয়, আঙ্গুল উঠেছে বিমান পরিচালনা পর্যদেরও একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধেও। বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়োগ প্রক্রিয়া আবার কবে হবে, বলতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কেউ। গত এপ্রিলে ট্রাফিক হেলপার পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলেও এখন তা অনিশ্চিত। সূত্র জানায়, এই নিয়োগ কেলেঙ্কারির সঙ্গে একজন প্রভাবশালী পর্ষদ সদস্যের পরোক্ষ ইন্ধন রয়েছে। খোদ বিমানেরই একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তিনি আগামী পর্বে বিমানের চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী। এ কারণে বিমান প্রশাসন শাখার তারই একজন ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক অনুষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে এ ধরনের একটি তুঘলকি নিয়োগ কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছেন। এরই মধ্যে পাইলট ও এয়ারক্রাফট মেকানিক পদে নিয়োগেরও প্রস্তুতি চলছে। বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারী বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন। তিনি বলেন, হয় তো পরীক্ষা পদ্বতিতেই ত্রুটি ছিল। সূত্র জানায়, বিমানের ভিতর ও বাইরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে জড়িত। অবস্থা এতটাই শোচনীয় বিমানের এমডিও অনেকটা অসহায় এ চক্রের সামনে। পর্ষদের একজন প্রভাবশালী সদস্যের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্বান্তের কারণেই বিমান এত বড় সংকটের মুখে পড়েছে। বিমানের এক পরিচালক জানান, ৪০ বছরের ইতিহাসে নিয়োগ নিয়ে এত বড় কেলেঙ্কারি কখনো ঘটেনি। তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে নিয়োগ দেওয়ার নামে এমন তুঘলকি সিদ্ধান্ত  নেওয়ায় চরম বিতর্ক ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে গোটা বিমানে। বিমানের নিজস্ব জনবলে পরীক্ষা নেওয়ার মতো সামর্থ্য, সুনাম ও গ্রহণযোগত্যা থাকার পরও বাইরে থেকে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্বান্তও রহস্যজনক। এ সম্পর্কে একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক আর তৃতীয় শ্রেণির কেরানি পদের চাকরির পরীক্ষা যদি আউটসোর্সিং করা হয় তাহলে তো বিমানেরও ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। তার মানে দাঁড়ায়-হয় বিমানের পরীক্ষা নেওয়ার মতো যোগ্যতা নেই- আর না হয় বিমানের সবাই দুর্নীতিবাজ। বিমানের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ৮টি শাখায় ক্যাজুয়েল ভিত্তিক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে ভয়াবহ কেলেঙ্কারি ঘটে। প্রতিটি নিয়োগে জনপ্রতি ৫ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। গত ৬ মাসে এই নিয়োগ বাণিজ্য করে সিন্ডিকেট কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিমানের প্রশাসন, সিকিউরিটি ও বিএফসিসি শাখার ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই সিন্ডিকেটের সদস্য। আছেন বিমানমন্ত্রীর একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। বিমানের একজন প্রভাবশালী জিএমের গোপন পরিকল্পনায় পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটি হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। বিমানের নিয়োগ নিয়ে গত দুই মাস ধরে সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসআপ, টুইটারে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তোলপাড় হয় বিমানের সর্বমহলে। বিমান সূত্রগুলো জানায়, নিয়োগ বাণিজ্য করতে এই সিন্ডিকেট  লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি নিয়ে ভয়াবহ অনিয়ম করে। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের পাস করানোর অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, জুনিয়র  কমার্শিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট, সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট, সিকিউরিটি গার্ড, ট্রাফিক হেলপার, গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট, জুনিয়র ট্রাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট, জুনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান পদে নিয়োগ পরীক্ষায় বিসিএসের প্রশ্নকেও হার মানিয়েছে। এ ছাড়া গোপন কৌশলে একজনের পরীক্ষা অন্য জনকে দিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে পাস করানোর মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটে। আর এ কাজটি করতে ছবি ছাড়া প্রবেশপত্র বিতরণ করা হয়। আবদুর রহিম নামে একজন চাকরি প্রার্থী জানান, বিমানের প্রশাসন শাখার জেনারেল ম্যানেজার মুমিনুল ইসলাম, তার  ছোট ভাই হিসেবে পরিচিত সিকিউরিটি শাখার তোফাজ্জাল  হোসেন, বিএফসিসির ফারুক, অ্যামপ্লয়মেন্ট শাখার ম্যানেজার সুদীপ পুরো নিয়োগ বাণিজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবদুর রহিম বলেন, ২-৩ মাস আগে বিমান থেকে তাকে  টেলিফোন করে জানানো হয়, তার আবেদনের সঙ্গে সব কাগজপত্র নেই। এসব কাগজপত্র না দিলে তার নাম বাতিল হয়ে যাবে। এটা ঠিক করতে হলে ১০ হাজার টাকা লাগবে। এরপর তিনি ৫ হাজার টাকা দিয়ে যাচাই-বাছাইয়ে নাম ওঠান। আবদুর রহিম বলেন, তাকে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলে ১৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়। তিনি ১০ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সিন্ডিকেট সাড়া দেয়নি। রহিম আরও অভিযোগ করেন, তার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ১২ লাখ টাকা দিয়ে প্রশ্ন  পেয়েছেন। ওই প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে তিনি পাস করেছেন। এর আগে বাংলাদেশ বিমানের ৩ শাখায় নিয়োগ নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কেবিন ক্রু, জুনিয়র ট্রাফিক সহকারী নিয়োগ ঘিরে সক্রিয় একটি সিন্ডিকেট। কেবিন ক্রু পদে নিয়োগে গড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ এবং জুনিয়র ট্রাফিক সহকারী নিয়োগে গড়ে ৫ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্যের ঘটনা ঘটে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেগুলোর লিখিত পরীক্ষা হয়েছে কিন্তু মৌখিক এখনো হয়নি সেগুলো অবশ্যই বাতিল করে নতুনভাবে পরীক্ষা নিতে হবে। আর না হয়- লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণদের তালিকা থেকে বিশেষ গ্রেস দিয়ে একটি পদের বিপরীতে তিনজনকে পাস করিয়ে মৌখিকে ডাকা যেতে পারে। এতে দুর্নীতিবাজরা ধরা খাবে এবং তাদের মুখোশ উন্মোচন হবে।

সর্বশেষ খবর