মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রূপগঞ্জে ইউপি চেয়ারম্যান আলমাছের নির্দেশে সৈনিক লীগ নেতাকে হত্যা

নেপথ্যে মাদক ব্যবসা, বালু ভরাট

নিজস্ব প্রতিবেদক

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, বালু ভরাট ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ সভাপতি তারা মিয়া নিহত হয়েছেন। মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছের নির্দেশে তার বাহিনীর লোকজন ওই সৈনিক লীগ নেতাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

গতকাল দুপুরে উপজেলার মঙ্গলখালী এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গোলাগুলি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে তারা মিয়া (৩৮) নামে সৈনিক লীগ নেতা নিহত হন। এ ঘটনায় নারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ সময় দুটি বাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। নিহত তারা মিয়া মঙ্গলখালী এলাকার মৃত চান মিয়ার ছেলে। তিনি মুড়াপাড়া ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ ঘটনায় নজরুল ইসলাম নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মুড়াপাড়া ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সভাপতি তারা মিয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা আইবুর মিয়া মঙ্গলখালীসহ আশপাশ এলাকার মাদক ব্যবসা, মিল-কারখানায় বালু ভরাটসহ বিভিন্ন কাজ করে আসছিলেন। এসব কাজ তাদের বুঝিয়ে দিয়ে আসছেন ইউপি চেয়ারম্যান তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছ। তারা দুজনই আলমাছের সহযোগী। চেয়ারম্যান হওয়ার আগেও তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছ নিজের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করতেন তারা মিয়া ও আইবুরকে। তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছ চেয়ারম্যান হওয়ার পর তারা মিয়া ও আইবুর মিয়াকে আলাদা করে গ্রুপ তৈরি করে দেন। এই তারা গ্রুপের লোকজনকে দিয়েই তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছ মিল-কারখানায় বালু ভরাট, চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন কাজ করিয়ে আসছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছের সঙ্গে নানা বিষয়ে তারা মিয়ার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। মাদক ব্যবসার ভাগ-বাটোয়ারা ও বালু ভরাটসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তারা মিয়ার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন চেয়ারম্যান আলমাছ। অভিযোগ রয়েছে, তারা মিয়াকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে নিজের গড়া আরেক বাহিনী আইবুর গ্রুপকে কাজে লাগান চেয়ারম্যান আলমাছ। এমনিতেই মাদকসহ প্রায় সবকিছু তারা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকায় আইবুর সব নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে সুযোগ খুঁজছিলেন। সে সুযোগ এসে যায় চেয়ারম্যান আলমাছ আর তারা মিয়ার মধ্যে দু-কুমড়া সম্পর্ক সৃষ্টি হলে। সাম্প্রতিক সময়ে আইবুর আধিপত্য বিস্তারে চেয়ারম্যান আলমাছের কাছে সহযোগিতা চান। চেয়ারম্যান আলমাছের হাতে যেন চাঁদ চলে আসে। আইবুর গ্রুপকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে তারা মিয়াকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান আলমাছ। বিষয়টি তারা মিয়া টের পান। এ নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই তারা গ্রুপ ও আইবুর গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছিল। গতকাল দুপুরে মাদক ও বালু ভরাটের ব্যবসা এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সভাপতি তারা মিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা আইবুর মিয়ার বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে আইবুর ও তার লোকজন আগ্নেয়াস্ত্র এবং ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা মিয়ার ওপর হামলা চালায়। তারা মিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে আইবুরের লোকজন। এ সময় তারা মিয়া ও তার লোকজন পাল্টা হামলা চালায়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিবিনিময় হয়। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে তারা মিয়া, নয়ন মিয়া, সুমন, হোসেন মিয়া, সুরুজ মিয়া, আকাশ, পাপ্পু, খোকন, আনোয়ার হোসেন, ফাতেমা, মাসুদা বেগম, পলি আক্তার, আফসানা আক্তার, রাহিমা বেগমসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে তারা মিয়াকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তারা মিয়ার নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ বক্সের উপ-পরিদর্শক (এসআই) বাচ্চু মিয়া। এদিকে সংঘর্ষ চলাকালে দুটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে বাড়িঘরসহ আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ সময় স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকাসহ মালামাল লুট করা হয় বলে দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। ঘটনার তাণ্ডবে আশপাশের হাট-বাজারের দোকানপাট বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। পরে ঘটনাস্থলে অতিরিক্তি পুলিশ পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। অন্যদিকে, তারা মিয়া নিহত হয়েছেন এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী মুড়াপাড়া-ভুলতা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের প্রশমনের চেষ্টা করে। তারা মিয়া নিহতের ঘটনায় এলাকায় চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনো সময় ফের সংঘর্ষ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। নিহতের চাচাতো ভাই সুমন মিয়া জানান, প্রতিপক্ষ আইবুর মিয়া, আক্তার হোসেন চুন্নু, বিল্লাল মুন্সী, শিপনসহ তাদের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় মাদক ব্যবসা করে আসছে। মাদক ব্যবসা করায় তাদের বিরুদ্ধে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছের কাছে অভিযোগ করেন তারা মিয়া। চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বের হয়ে আসার মুহূর্তে ওই মাদক ব্যবসায়ীরা পায়ে গুলি এবং মাথায় কুপিয়ে আঘাত করে তারা মিয়াকে হত্যা করে। অভিযোগ উঠেছে, ১২ এপ্রিল ইউপি নির্বাচন ঘিরে চেয়ারম্যান প্রার্থী তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছের সমর্থকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান প্রার্থী জাব্বারের সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে জাহাঙ্গীর নামে এক মাইক্রোবাস চালক আহত হন। তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মাইক্রোবাস চালক জাহাঙ্গীর মারা যান। চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করতে আলমাছ পরিকল্পিতভাবে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই জাহাঙ্গীরকে মেরে ফেলেন বলে দাবি করেছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভুঁইয়া ও ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী জাব্বার। এরপর এক মহিলাকে জাহাঙ্গীরের আত্মীয় সাজিয়ে ওই দুজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করান তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছ।

জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) ফারুক আহাম্মেদ, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।  রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সর্বশেষ খবর