বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ডিজিটাল প্রতারণা ভয়ঙ্কর

জিন্নাতুন নূর

ডিজিটাল প্রতারণা ভয়ঙ্কর

দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ ডিজিটাল প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে পড়ে তারা শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হচ্ছেন। এ জন্য কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা সামাজিকভাবে অপমানিত ও লজ্জিত হচ্ছেন। মূলত প্রতারক চক্র ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী সহজ-সরল ক্রেতা, প্রযুক্তি সম্পর্কে অসচেতন ব্যক্তি, দরিদ্র বেকার যুবক এবং কিশোর-কিশোরীদের সহজেই প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এ সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানুষকে সচেতন করলেও কার্যত কোনো লাভ হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একজন ব্যক্তির আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা, অশ্লীল লিংক ছড়িয়ে ব্যবহারকারীকে বিব্রত করা, কারও ফেসবুক বা ই-মেইল আইডি হ্যাক করে অর্থ দাবি করা, গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ তৈরি করা, ঘরে বসে অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন সাইটের সদস্য হতে ফি আদায় করা, ভুয়া ডিজিটাল জন্ম সনদ প্রদান, অনলাইন শপের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে প্রতারণা এবং মোবাইলে লটারি জেতার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আদায়সহ প্রতারক চক্র বিভিন্নভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।

প্রযুক্তিবিদরা বলেন, সামাজিক মিডিয়ার অপরাধ প্রতিরোধে আমাদের কোনো ফরেনসিক ল্যাব গড়ে ওঠেনি। এ জন্য ফেসবুকে সংগঠিত বিভিন্ন অপরাধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি প্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধের জন্য দেশে যে আইন রয়েছে সেটিও বিশেষায়িত নয়। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে।    

ডিজিটাল প্রতারণার মধ্যে ফেসবুকে ফটোশপের মাধ্যমে একজনের ছবির সঙ্গে আরেকজনের ছবি জুড়ে দিয়ে অসাধু কিছু ব্যবহারকারী দীর্ঘদিন ধরে সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। সাধারণত কোনো পর্নো ছবির নায়িকার দেহের সঙ্গে একটি নারীর চেহারা জুড়ে দিয়ে এমন ছবি তৈরি করা হয়। পরে এই ছবি আপলোড করার হুমকি দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করা হয়। কিছুক্ষেত্রে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে প্রতিশোধ নিতে এবং বিকৃত আনন্দ পেতে বখাটেরা এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ কাজ করে। ফেসবুকে দীর্ঘদিন ধরে নারী ব্যবহারকারীদের আপত্তিকর ছবি ও ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে আসছিল ‘ডেসপারেটলি সিকিং আনসেন্সরড’ (ডিএসইউ) নামের একটি চক্র। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, গত ১২ অক্টোবর এই গ্রুপের তিনজন এডমিনকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেন, এই চক্রটি দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, অভিনেতা, শিক্ষার্থী ও মেয়েদের আপত্তিকর ছবি এই গ্রুপে পোস্ট করে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছিল। তারা যে কোনো অপরিচিত মানুষের ছবি ও গোপনে ধারণকৃত ভিডিও লিংক ফেসবুকে শেয়ার করে তাতে আপত্তিকর মন্তব্য করে আসছিল। এতে ভুক্তভোগীদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেসবুকে নারীদের উত্ত্যক্ত করা, প্রেমের ফাঁদে ফেলে আপত্তিকর ছবি মোবাইলে ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা আগের তুলনায় বেড়েছে। ফেসবুকের পরিচয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলে এক শ্রেণির কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তি মেয়েদের একান্ত ব্যক্তিগত ছবি চেয়ে নিয়ে পরে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েও অর্থ আদায় করছে। জানা যায়, প্রতারকরা ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ আদায় করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তার ব্যক্তিগত তথ্য কতটা মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করবেন তা তাকে সুচিন্তিতভাবে ঠিক করে নিতে হবে। বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার জন্য সহজ পাসওয়ার্ড ব্যবহার না করাই ভালো। আর স্পর্শকাতর তথ্য ফেসবুকে দেওয়া উচিত নয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া এখন ‘পারসোনাল মিডিয়া’তে পরিণত হয়েছে। এর খারাপ-ভালো দুটো দিকই আছে। সমাজের কুরুচিপূর্ণ কিছু মানুষ ফেসবুককে খারাপ কাজে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, পারসোনাল মিডিয়ায় রেগুলেশন না থাকায় ফেসবুকের এই ধরনের অপব্যবহার হচ্ছে। এ অধ্যাপকের মতে, আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা দুর্বল। অন্যদিকে এসব প্রতিরোধে বিটিআরসিরও কারিগরি, যন্ত্রপাতি ও জ্ঞানের ঘাটতি আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে ফেসবুককে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে মহানবী (সা.) ও ইসলাম সম্পর্কিত কটূক্তি ও গুজব ছড়িয়ে একটি শ্রেণি ফেসবুকে উসকানিমূলক ছবি দিয়ে ধর্মীয় দাঙ্গা ছড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনায় বিশেষ একটি মহল গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করেছে। এমনকি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজেও প্রতারকরা ফেসবুক ব্যবহার করছে। মেডিকেলসহ, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন, এসএসসি, এইচএসসি, জেডিসি ও জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র ফেসবুকে ফাঁস করছে। মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিল থাকুক আর না থাকুক ফাঁসকৃত প্রশ্নের জন্য শিক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া হচ্ছে টাকা। সম্প্রতি ডিএমপির ডিবি (পশ্চিম) বিভাগের একটি টিম এমন একটি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে টাকা ও ডলার উপার্জনের কথা বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় দেখা যায়। কিন্তু এখানেও প্রতারক চক্র সক্রিয়। এই ধরনের আশ্বাসের মাধ্যমে অল্প সময়ে কম বিনিয়োগ ও শ্রমের বিনিময়ে ঘরে বসে মোটা টাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণের টাকা। যদিও অনলাইনে আউটসোর্সিং করতে প্রয়োজন শ্রম ও মেধা। এ জন্য কোনো অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। যেমন— ডুল্যান্সারের মাধ্যমে নতুনভাবে এখন মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। দেশের শহর থেকে গ্রামে অনেকেই এখন এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন। কিন্তু এটি ফ্রিল্যান্সিং সাইট হওয়ার পরও এর জন্য অনেকে সদস্য ফি দিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা ডুল্যান্সারের সদস্য হতে ১০০ ডলারের ফি দিচ্ছেন। এর মধ্যে ১০ ডলার সদস্য হওয়ার সময় বাকি ৯০ ডলার তিন মাসের কিস্তিতে দিচ্ছেন। অথচ এর কোনো সদস্য ফি থাকার কথা না। এ ছাড়া মোবাইলে ক্ষুদে বার্তায় বা ফোন দিয়েও একজন গ্রাহককে ‘আপনি লটারি জিতেছেন’ এমনটি জানিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এ জন্য ভুক্তভোগীদের বিশাল অঙ্কের টাকার লোভ দেখিয়ে প্রতারকরা সেই টাকা পেতে তার কাছ থেকে নিবন্ধন ফি হিসেবে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থ একটি নম্বরে বিকাশ করে দেওয়ার কথা বলেন।

যা একজনকে ফ্লেক্সিলোডের মাধ্যমে পাঠাতে হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি কেবলই প্রতারণার ফাঁদে পড়েন, তার ভাগ্যে জুটে না কোনো লটারির অর্থ। এমনকি ব্যক্তিগত ই-মেইলের মাধ্যমেও অনেক সময় একজনের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।              

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর