বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
রিজার্ভ চুরি

বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৫ কর্মকর্তা জড়িত

রিজার্ভ চুরি নিয়ে সিআইডির তদন্ত, সংসদীয় কমিটির ক্ষোভ

আলী আজম

বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৫ কর্মকর্তা জড়িত

নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে গচ্ছিত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে ওই ব্যাংকের ১৫ জন কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সিআইডি। এ ছাড়া ২০ জন বিদেশি নাগরিক এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হলেও এতে ৩০ জনের বেশি জড়িত রয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছে সিআইডি। এদের ব্যাপারে সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইন্টারপোল এবং সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি দেশ তদন্তের কাজে সহযোগিতা করছে। রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সূত্রটি বলছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬০ জন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তও পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তথ্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক (এডি) থেকে উচ্চপর্যায়ের ডেপুটি গভর্নর পর্যায়ের এসব কর্মকর্তাকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৫ জন কর্মকর্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু তদন্তের   স্বার্থে তাদের নাম বলছেন না সংশ্লিষ্টরা। শিগগিরই এদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাইবার আইটেমগুলো জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়মিতই যাওয়া হচ্ছে। জড়িতদের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হতে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ মামলার তদন্তে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হচ্ছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মতিঝিল থানায় করা মামলাটি ১৫ মার্চ সিআইডির হাতে আসে। ১৫ মার্চ থেকে সিআইডি তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। জানা গেছে, এ মামলার তদন্তে ইন্টারপোল সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া জাপান, ম্যাকাও, শ্রীলঙ্কা, বেলজিয়ামসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করছে। মামলার তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জড়িতদের ব্যাপারে চার্জশিট প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাদের যোগসাজশ ছাড়া রিজার্ভ চুরি সম্ভব হতো না। সিআইডি বলছে, ৪, ৫ ও ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৃতীয় কেস কার্ডিনেশন মিটিং সিঙ্গাপুরে অুনষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ, ভারত, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন ও চীন অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া ইন্টারপোল ও বিশ্বব্যাংকও ছিল। এসব দেশ ও দুটি সংস্থা থেকে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ২৪ জন। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অর্থ উদ্ধার ও মামলার তদন্তে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তারা সহযোগিতা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে। চতুর্থ কেস কার্ডিনেশন মিটিং এ মাসেই বাংলাদেশে হওয়ার কথা রয়েছে।

সিআইডি সূত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে সুইফটের শক্তিশালী সুরক্ষিত সার্ভারকে কীভাবে দিনে দিনে দুর্বল করা হয়েছে তা জানা গেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই সার্ভারে প্রবেশ সম্ভব নয়। সেখানে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে হ্যাকাররা অনায়াসে ওই সার্ভারে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে সার্ভার হ্যাক করে পাঁচটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয় তারা। এই অ্যাকাউন্টের মধ্যে ফিলিপাইনের চারটি এবং শ্রীলঙ্কার একটি রয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে মতিঝিল থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি মামলা হয়। মামলার তদন্ত শুরু করে সিআইডি। তদন্তের একপর্যায়ে শ্রীলঙ্কা ২০ মিলিয়ন ডলার এবং ফিলিপাইন ৬৮ হাজার ৩০৫ ডলার ফেরত দেয়। সর্বশেষ ফিলিপাইন থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ। সিআইডি মনে করে, বাংলাদেশের প্রচলিত মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী, জড়িতদের জেল-জরিমানাসহ চুরি করা অর্থের দ্বিগুণ ফেরত দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৫ জন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তারা যাতে দেশ ত্যাগ না করতে পারেন এ জন্য স্থল, নৌ ও আকাশপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা দেশ ত্যাগ করলে তথ্য-উপাত্ত ও মামলার আলামত নষ্ট করে ফেলতে পারেন। এমনকি তদন্তের সব পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন। সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৫ জন কর্মকর্তার চরম গাফিলতি পাওয়া গেছে। টাকা কীভাবে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে তা বের করা হয়েছে। এর সঙ্গে কারা কীভাবে জড়িত তাও বের করা হচ্ছে। এ মামলার তদন্তে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হচ্ছে। ফলে তদন্তকাজ শেষ হতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন।

রিজার্ভ চুরি প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটিকে না দেওয়ায় ক্ষোভ : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়ার পরও না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। একই সঙ্গে ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ না করে কাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সে প্রশ্নও উঠে বৈঠকে। বৈঠক শেষে এ বিষয়টি নিয়ে কমিটির একাধিক সদস্য সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সংসদ ভবনে গতকাল অনুষ্ঠিত সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২৯তম বৈঠকে এসব সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি কর্নেল শওকত আলী (অব.)। কমিটি সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া (অব.), আবদুর রউফ, অ্যাডভোকেট নাভানা আক্তার বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, বিগত বৈঠকে কমিটির সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়ে ড. ফরাস উদ্দিন কমিটির রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে চান। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক রিপোর্টের কোনো কপি কমিটির কাছে পাঠায়নি বলে জানান কমিটি সচিব।

কমিটি সভাপতি শওকত আলী বলেন, রিপোর্ট যদি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় তাহলে কমিটিতেও দিতে পারে। কারণ সংসদীয় কমিটি সংসদেরই অংশ। কমিটির সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, এই রিপোর্ট সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নরকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা ছিল। কমিটির আরেক সদস্য হাবিবর রহমান বলেন, বিষয়টি স্পষ্ট করে জানানো দরকার। সংসদ সচিবালয় জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বোর্ড-এর সার্বিক কার্যক্রম ও বিগত পাঁচ বছরের অডিট আপত্তি নিয়ে আলোচনা হয়। কমিটি অডিট আপত্তিসমূহ দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে আইন সংগতভাবে দ্রুত নিষ্পত্তির সুপারিশ করে।

সর্বশেষ খবর