শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অরক্ষিত আকাশসীমা

রাডার না থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত বিমানের অবতরণ ঝুঁকি সমুদ্রসীমার আকাশের নিয়ন্ত্রণ নেই

মির্জা মেহেদী তমাল

অরক্ষিত আকাশসীমা

অরক্ষিত বাংলাদেশের আকাশসীমা। শক্তিশালী রাডার না থাকায় বিশাল সমুদ্রসীমার আকাশে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সিভিল এভিয়েশনের। অনাকাঙ্ক্ষিত উড়োজাহাজের অবতরণ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার সিস্টেম বহু পুরনো। তাই এটি দিয়ে সব এয়ারলাইনসের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন সমুদ্রসীমায় কোনো এয়ারক্রাফট এলেও এই রাডার তা ধরতে পারে না। এ অবস্থায় দেশ যেমন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে, তেমন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আকাশপথে চলাচল করা ভিনদেশি ফ্লাইট থেকেও বিপুল অঙ্কের ওভারফ্লাইং নেভিগেশন ফি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সিভিল এভিয়েশন সূত্রগুলো জানায়, এয়ার কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্ট—এসিএমের আওতায় রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পিপিপির আওতায় রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। সূত্র জানায়, দেশি-বিদেশি একটি সিন্ডিকেটের অপতত্পরতা নতুন শক্তিশালী রাডার স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সিন্ডিকেটের কারণেই নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে সিভিল এভিয়েশন। পুরনো রাডার দিয়েই কাজ চালানোর জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে এ চক্রটি। এতে একদিকে যেমন পুরনো রাডার রক্ষণাবেক্ষণের নামে লুটপাট ও কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ থাকছে, তেমন বিদেশি এয়ারলাইনসের কাছ থেকেও আর্থিক ফায়দা লোটার সুযোগ থাকছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) উইং কমান্ডার চৌধুরি জিয়া উল কবীর   জানান, নতুন রাডার প্রতিস্থাপনসংক্রান্ত ফাইলটি শিগগির ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হবে। এটা হয়ে গেলে নতুন সমুদ্রসীমার ওপর দিয়ে যে কোনো এয়ারক্রাফট প্রবেশ করলেই বাংলাদেশ তার ওপর চার্জ আরোপ করতে পারবে। এতে সিভিল এভিয়েশনের আয় আরও ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়বে। সবচেয়ে বড় বিষয় পিপিপি প্রকল্পে এমন একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এডিএসবি চালু করা হবে, যা দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়াও গোটা সমুদ্রসীমা এলাকার ছবি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধারণ করা যাবে। তখন প্রতিটি উড়োজাহাজ চলাচলের নির্ভুল চিত্র পাওয়া যাবে। কেউ আর কিছু ফাঁকি দিতে পারবে না। সূত্র জানায়, বর্তমান রাডার সিস্টেম বর্ধিত সমুদ্রসীমার ওপর দিয়ে যেসব এয়ারক্রাফট যাচ্ছে সেগুলো ধরতে পারে না। এসব এয়ারক্রাফটের ওপর কোনো চার্জও ধরা যাচ্ছে না। বহুকালের পুরনো রাডারের কারণে এখন দেশের আকাশসীমার মধ্যেও অনেক এয়ারক্রাফটের অবস্থান ধরা যায় না। সিভিল এভিয়েশন বর্তমানে শুধু ওভারফ্লাইং খাত থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা আয় করছে। নতুন সমুদ্রসীমার ওপর অ্যারোনটিক্যাল চার্জ আদায় কার্যকর হলে শুধু এ খাতের আয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় দ্রুত দেশের বর্ধিত সমুদ্রসীমার ওপর দিয়ে যাওয়া বিদেশি উড়োজাহাজের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সম্প্রতি পাঠানো এ-সংক্রান্ত একটি বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সরকার দ্রুততম সময়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ—পিপিপির আওতায় এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প হাতে নেয়। এজন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার প্রতিস্থাপনসহ এ-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের একটি ধারণাপত্র তৈরির নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের আওতায় অত্যাধুনিক এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে সিভিল এভিয়েশনের আয় বাড়বে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে সাগরের নতুন ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার যে অংশ বাংলাদেশ পেয়েছে, ওই এলাকা দিয়েই বিশ্বের অধিকাংশ এয়ারলাইনস ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমানার ওপর দিয়ে দিনে ৪০০ বিদেশি ফ্লাইট আসা-যাওয়া করছে। ভারতের কাছ থেকে নতুন অংশ পাওয়ায় এ ফ্লাইট সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে। এতদিন ভারত ওইসব ফ্লাইটের কাছ থেকে ওভারফ্লাইং ফি আদায় করেছে। বাংলাদেশ এতদিন ধরেই বঞ্চিত এ আয় থেকে।

অনাকাঙ্ক্ষিত উড়োজাহাজের ঝুঁকিপূর্ণ অবতরণ : আকাশসীমায় ১০ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজের তথ্য পুরনা রাডার দিয়ে পাওয়া যায়। এর ওপর দিয়ে উড়ে গেলেই সে তথ্য আর পাওয়া আসে না। ইতিপূর্বে ফিলিপাইন থেকে আসা একটি উড়োজাহাজ শাহজালাল বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করলেও রাডারে তা ধরা পড়েনি। যখন ধরা পড়ল ততক্ষণে উড়োজাহাজটি অবতরণ করে ফেলে। এ ঘটনায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, আগামী ৫০ বছরের জন্য নিরাপদ আকাশসীমা নিশ্চিতে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন রাডারসহ এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের এ প্রকল্পটি পিপিপির মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত পিপিপি অফিস এবং সিএএবির তত্ত্বাবধানে চলতি বছরের ২২ জুন এ-সংক্রান্ত দরপত্র জমা পড়ে। কিন্তু দরপত্র জমাদানের পরই দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি আদালতের আশ্রয় নিয়ে একই বিষয়ের ওপর বার বার মামলা করে কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সিভিল এভিয়েশন জানায়, সর্বাধুনিক রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার স্থাপনের এ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর দফতরাধীন পিপিপি সেলের প্রথম আনসলিসিটেড প্রকল্প। পিপিপির মাধ্যমে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে সিএএবির কোনো অর্থ ব্যয় হবে না বরং আগামী ২০ বছরে সরকার ২ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করতে পারবে। পিপিপির আওতায় ১০ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে রাডার রক্ষণাবেক্ষণ, খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও রাডার অপারেটর এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীসহ আনুমানিক ১৫০ জনকে দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যারা প্রকল্পটির কার্যাদেশ পাবেন তাদের আগামী ১০ বছরের মধ্যে তাদের খরচসহ লাভের একটি অংশ দেওয়া হবে। কারিগরি মূল্যায়নে উত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠান মেসার্স করিম অ্যাসোসিয়েটস তাদের আর্থিক প্রস্তাবে ১০ বছরের জন্য মোট ১ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করেছে, যার নেট মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা। অথচ এ প্রকল্পটি সিএএবি কর্তৃপক্ষ পিপিপি ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করলে ব্যয় দাঁড়াত ৮০০ কোটি টাকারও বেশি। পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সিএএবি তথা সরকারের প্রাক্কলিত অর্জন হবে ন্যূনতম ৩০০ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে সিএএবি প্রকল্পের এই ৭০০ কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে গচ্ছিত রাখলে পিপিপি খাতে ১ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা খরচের পরও সিএএবির অর্জন হবে ২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পে যে খরচ উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে ঢাকায় অবস্থান করছেন আইকাও টিসিবি এক্সপার্ট মি. নিকস গামভিবিস। তিনি এ প্রকল্পের প্রস্তাব মূল্যায়ন করে মতামত দেওয়ার পরই ফের পাঠানো হবে মন্ত্রণালয়ে; যাতে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক না থাকে। আন্তর্জাতিকভাবেও প্রকল্পটির স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্যই এমন উদ্যোগ নিয়েছে সিভিল এভিয়েশন।

সর্বশেষ খবর