রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যানজটের যত কারণ

মাসের পর মাস উন্নয়নের নামে খোঁড়াখুঁড়ি, ভাঙাচোরা রাস্তার অধিকাংশই বেদখলে

সাঈদুর রহমান রিমন

যানজটের যত কারণ

দুঃসহ যানজটে ক্রমেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে রাজধানী। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়ক, মোড়, ট্রাফিক ক্রসিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা মানুষজন সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। বেশ কয়েকটি প্রধান রাস্তা এবং গলিপথে মাসের পর মাস ধরে চলছে উন্নয়নের নামে ধারাবাহিক খোঁড়াখুঁড়ি। যেখানে সেখানে পড়ে থাকছে জঞ্জাল ও নির্মাণ সামগ্রীর স্তূপ। ভাঙাচোরা, খানাখন্দকে পুরো রাস্তার একাংশ বেদখল, অর্ধেক রাস্তাজুড়ে থাকছে শত শত গাড়ির এলোপাতাড়ি পার্কিং। মধ্যরাস্তায় বাস-মিনিবাস থামিয়েই চলে যাত্রী উঠানো-নামানো।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, রাজধানীর ৩৭টি পয়েন্টে ২৪ কারণে হরহামেশা যানজট লেগেই থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে— রাস্তার স্বল্পতা, সমন্বয়হীন রুট পারমিট প্রদান, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল, মাত্রাতিরিক্ত রিকশা, সড়কের অপ্রশস্ততা, বেপরোয়া বাস-মিনিবাস, যত্রতত্র ট্রাক স্ট্যান্ড, রেল গেট, মিনিবাস, হিউম্যান হলারের মাত্রাধিক্য যানজটকে রীতিমতো স্থায়ী রূপ দিয়েছে। এ ছাড়া বছরজুড়ে বিভিন্ন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, জলাবদ্ধতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে অপরিকল্পিত পার্কিং, ফুট ওভারব্রিজের অভাব— আবার থাকলেও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পথচারীদের অনীহা, রাস্তাজুড়ে বড় বড় আবর্জনার কনটেইনার দুঃসহ যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি পার্কিংবিহীন বহুতল ভবন, ব্যারিয়ারবিহীন ভিআইপি রোড, অটো সিগন্যালের অভাব ও অব্যবহার বিকল্পহীন ভিআইপি রোড, রাস্তার ওপর বাস টার্মিনাল, একমুখী রাস্তায় ডিভাইডার, যত্রতত্র হকার্স মার্কেট-কাঁচাবাজার  গড়ে তোলাসহ ভাঙাচোরা রাস্তা যানজটকে দীর্ঘায়িত করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মগবাজার, উত্তরা, পল্লবী, মিরপুর, প্রগতি সরণিসহ নগরীর ২১টি পয়েন্টে একযোগে নানা উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। সেসব স্থানে রাত-দিন ভয়াবহ যানজট যেমন লেগে থাকে, তেমনি ধুলাবালি-ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে যাত্রী-পথচারীরা। অন্য ১৩ পয়েন্টও নানা কারণে যানজটের ভয়াবহতায় আটকে থাকছে।

অব্যাহত যানজটের বেহাল পরিস্থিতিতে স্থবির হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। প্রধান প্রধান সড়কজুড়েই ভয়াবহ যানজট, তা মুহূর্তে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে অলিগলি মহল্লাতেও। নগরীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাতায়াতে দিনের অর্ধেক সময় লেগে যায়। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাস্তবে রাস্তার তুলনায় গাড়ি বেশি এবং গাড়ির তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হওয়ার কারণেই নগরীতে যানজট সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়ি নামছে, কিন্তু রাস্তা বাড়ছে না মোটেও। প্রতিটি সড়কের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। সর্বোপরি অসংখ্য রিকশা তো আছেই। এসব কারণে যানজট নিরসনে বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজনও সুফল বয়ে আনতে পারছে না।

রাজধানীতে সায়েদাবাদ, খিলগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, সোনারগাঁও-এফডিসি ও মহাখালী রেলগেট— এসব এলাকা যানজটের অন্যতম কারণ। রেলওয়ে সূত্র জানায়, রাজধানীর ২৯টি রেল গেট পেরিয়ে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৮০টি ট্রেন চলাচল করে। গড়ে ২০ মিনিট অন্তর ট্রেন চলাচল করে থাকে। তবে পুলিশের হিসাবে প্রতি ১২ মিনিট অন্তর রেল গেট বন্ধ করা হয়। এতে আটকে যায় যানবাহন, গড়ে ওঠে দীর্ঘ যানজট।

রাজধানীর স্কুলগুলোর সামনে ছাত্রছাত্রী-অভিভাবকদের জটলা, এলোমেলো গাড়ি পার্কিং, প্রাইভেট কার, রিকশার জটলা— সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর অবস্থা। ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তাগুলোতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীসহ পথচারী ও এলাকাবাসী। শহরের বড় বড় রাস্তার যানজট পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত ভিতরের দিকের রাস্তায়, এমনকি আবাসিক এলাকাগুলোতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষত স্কুলগুলোর সামনে যানজটের এই ভোগান্তি অসহনীয়।

রাস্তাজুড়েই মিনি টার্মিনাল : ফকিরাপুল মোড়ে গড়ে ওঠা আন্তঃজেলা কোচ স্ট্যান্ডটির কারণে নয়াপল্টন থেকে মতিঝিল এবং রাজউক ভবন থেকে শাহজাহানপুর মোড় পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকায় দিন-রাত যানজট লেগেই থাকে। অভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলাবাগান, কমলাপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী ও জয়কালী মন্দির এলাকায়। এসব স্থানে প্রধান রাস্তাজুড়ে দূরপাল্লার কোচ কাউন্টার বসিয়ে এলোপাতাড়ি স্ট্যান্ডে পরিণত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কোচ স্ট্যান্ডগুলো ঘিরে সৃষ্ট যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সীমাহীন ভোগান্তি পোহায় লোকজন। এদিকে নগরীতে চলাচলরত বাস, মিনিবাস, ম্যাক্সি, রাইডার, দুরন্তসহ মেট্রো সার্ভিসের প্রায় ২০ হাজার পরিবহনের জন্য নির্ধারিত কোনো টার্মিনাল না থাকায় ব্যস্ততম সড়কগুলোই টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। রাতে মহাখালী টার্মিনাল থেকে মহাখালী মোড় পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে তিন সারিতে শত শত কোচ পার্কিং করে রাখা হয়। ফাঁকা রাখা সামান্য একচিলতে রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাতায়াতও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। রাস্তাকে টার্মিনালে পরিণত করায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে প্রগতি সরণির কুড়িল-বাড্ডা-রামপুরা এলাকায়। মিরপুরগামী বাস-মিনিবাসের জমজমাট ছয়টি টার্মিনাল গড়ে উঠেছে প্রগতি সরণিতেই। নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা ও মেরুল বাড্ডা এলাকায় অবৈধ ‘রাস্তা টার্মিনালগুলো’ ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি করেছে।

অভিজাত গুলশানের স্থায়ী অভিশাপ : রাস্তা, অলিগলি সর্বত্রই কয়েক সারিতে গাড়ি পার্কিং করে রাখায় দুঃসহ যানজটে গুলশান-বনানী-বারিধারার বেশির ভাগ এলাকায় স্থবির হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী, গ্রাহকসহ সব শ্রেণির মানুষের নিয়মিত যাতায়াত গুলশান-বনানীতে। তারা নিয়ে আসেন প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পাজেরো জিপসহ হরেক রকমের গাড়ি। এতসব গাড়ি বহনকৃত যাত্রীদের আবার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আশপাশেই দিনভর পার্কিং করে রাখা হয়। ফলে ৫ সহস্রাধিক গাড়ির ভিড়ে সমগ্র গুলশান-বনানী সারা দিনই স্থবির থাকে। সকালে স্কুল ও অফিসগামী যাত্রীদের যাত্রা থেকেই শুরু হয় যানজটের, দুপুরের মধ্যেই সে জট ভয়াবহ রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অলিগলিতে। ট্রাফিক পুলিশ সূত্রগুলো জানায়, যে কয়েকটি পয়েন্টের যানজট পুরো রাজধানী অবরুদ্ধতার জন্য দায়ী তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গুলশান-বনানী। সেখানে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত থাকে ভয়াবহ যানজট। রীতিমতো হতশ্রী অবস্থা।

সর্বশেষ খবর