রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

বাঘ বাড়ছে সুন্দরবনে

মোস্তফা কাজল, সুন্দরবন থেকে ফিরে

বাঘ বাড়ছে সুন্দরবনে

অবশেষে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে বনের কয়েকটি স্থানে চার বাঘিনী দুই দুই করে চার বাচ্চা নিয়ে ঘুরেও বেড়িয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন, বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর যৌথ মনিটরিং ও বনে প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের ফলে বাঘের সংখ্যা বেড়ে ১১৪টিতে দাঁড়িয়েছে।

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে—এ বিষয়ে গত তিন দিন সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী, কটকা, দুবলার চর ও চাঁদপাই এলাকা ঘুরে খবরের সত্যতা পাওয়া গেছে। দেবোকি ফরেস্ট অফিসের বন কর্মী মণ্ডল মিয়া জানান, ১৪-১৫ দিন আগে তিনি বন এলাকা পাহারা দেওয়ার সময় সন্ধ্যার আগে দেখতে পেয়েছেন এক বাঘিনী দুটি ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে নদীর ধারে পানি পান করছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষয়টি বন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। এভাবে আরও তিন জায়গায় বাচ্চা নিয়ে বাঘিনীকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। ফলে সুন্দরবনের ওই চার এলাকায় পর্যটক ও কাঠ ব্যবসায়ীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকজন বন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেছেন, বনদস্যু, জলদস্যু ও চোরা শিকারিরা বাঘের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে বাধা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসব বাধা অতিক্রম করা গেলে বাঘের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এমনকি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাঘের সংখ্যা বেড়ে ৫০০-তে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।

সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্র জানায়, কতিপয় চোরা শিকারির পাশাপাশি বনদস্যুরাও তাদের মুনাফার আশায় বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ চামড়া, হাড় পাচারে জড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা গত বছর পর্যন্ত কমেছে। সূত্র জানায়, সুন্দরবন বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল এই সুন্দরবনকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। এখানে এক সময় সাড়ে ৪০০-৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিচরণ করত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিরূপ পরিবেশ, চোরা শিকারিদের হামলা ও লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় জনরোষের শিকার হয়ে কিছু বাঘের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই প্রকাশিত ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা জরিপ অনুয়ায়ী, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। অথচ ২০০৪ সালে বন বিভাগ এনএনডিপির সহায়তায় বাঘের পায়ের ছাপ গুনে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল ৪৪০টি। ২০০৬ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করে এর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ২০০টি।

জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সাইদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের বাঘ ও সম্পদ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বনবিভাগও কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এরই মধ্যে বাঘসহ বন্যপ্রাণী রক্ষায় গোটা সুন্দরবন জুড়ে স্মার্ট টহল নামের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সার্বক্ষণিক পাহারা চলছে। ফলে গত এক থেকে দেড় মাস ধরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বাচ্চাসহ বাঘিনীদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। সুন্দরবনে এখন খুব সহজেই বাঘের দেখা মিলছে। বর্তমানে বাঘের বসবাসের জন্য সুন্দরবনে অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে।

এদিকে পরিবেশবিদরা বাঘ কমে যাওয়া কারণ সম্পর্কে জানান, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। কারণ সিডর ও আইলায় নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানি বনের ভিতর প্রবেশ করে আর বের হতে পারছে না। এতে বনের মিষ্টি পানির পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভরে যাওয়ায় বাঘ মিষ্টি পানির সন্ধানে লোকালয়ে প্রবেশ করে। তখনই এগুলো মানুষের রোষানলে পড়ে।

এ ছাড়া সুন্দরবন বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় চোরা শিকারিদের টার্গেট সুন্দরবনের বাঘ। বিদেশে এই চামড়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, গুলি করে বাঘ হত্যা করে। বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার করে দেয়। বাঘ ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের যে সিন্ডিকেটগুলো রয়েছে তাদের অনেকে বাঘের চামড়া ও হাড়গোড়সহ বিভিন্ন সময় র‌্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের হাতে আটক হলেও আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে এরা পুনরায় একই পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। এটাও বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিকূল দিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর