মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার করিনি

সশস্ত্র বাহিনী দিবসে প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার করিনি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুস্পস্তবক অর্পণ শেষে মন্তব্য বইতে স্বাক্ষর করেন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে কখনো ব্যবহার করিনি। বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে বহরে যুক্ত করা হবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন আধুনিক সমরাস্ত্র। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে গতকাল বিকালে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান স্মরণ করে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর খ্যাতি অর্জনে সরকারের নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণের সূচনা করে। প্রতিবছর দিনটি ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ হিসেবে পালন করে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মো. আবদুল হামিদ সকাল ৮টায় ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর আত্মদানকারী শহীদদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল এ সময় অভিবাদন প্রদান করেন। পরে রাষ্ট্রপতি শিখা অনির্বাণ প্রাঙ্গণে রাখা দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিখা অনির্বাণে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সেনানিবাসে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান তিন বাহিনীর প্রধান ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন। বিকালে সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, উচ্চ আদালতের বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শীর্ষস্থানীয় পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, সম্পাদকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেনাকুঞ্জে যাওয়ার আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী রাশেদ খান  মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, ড. মসিউর রহমান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংস্কৃতিক ব?্যক্তিত্ব অনুষ্ঠানে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী সেনাকুঞ্জে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান তিন বাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ ও এয়ার মার্শাল আবু এসরার। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বিউগলে সুরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ানোর পর জাতীয় সংগীত বেজে ওঠে। জাতীয় সংগীত শেষে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী আধুনিকায়নের সঙ্গে বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে বলেন, অতি শিগগিরই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পটুয়াখালীর লেবুখালীতে একটি পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা লাভ করতে যাচ্ছে। দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্রিগেড পর্যায়ে স্পেশাল ফোর্স গঠনের বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় রয়েছে।

নৌবাহিনীর আধুনিকায়নে দুটি সাবমেরিন সংযোজনের কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা, যা চীন থেকে অচিরেই আসছে।

তিনি বলেন, নৌবাহিনী যেন আকাশেও চলতে পারে, সাগরেও চলতে পারে এবং সাগরের তলদেশেও চলতে পারে, সেই সুরক্ষা আমরা করে দিয়েছি। বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

এর আগে সকালে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা সেনানিবাসের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে এই অনুষ্ঠানে খেতাবপ্রাপ্ত ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর ২০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।

এরপর তিনবাহিনী প্রধানগণ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আজ সেনাবাহিনী প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান নিজ নিজ বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা দেবেন। নৌবাহিনী প্রধান গতকাল নিজ বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা/তাঁদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা দিয়েছে। ঢাকা ছাড়াও সাভার, বগুড়া, ঘাটাইল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, রংপুর, খুলনা এবং রাজেন্দ পুর সেনানিবাসসমূহেও সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। দেশের অন্যান্য সেনা গ্যারিসন, নৌ জাহাজ ও স্থাপনা এবং বিমান বাহিনী ঘাঁটিতেও বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়। ঢাকা (সদরঘাট), নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, মংলা, চাঁদপুর ও বরিশালে বিশেষভাবে সজ্জিত নৌবাহিনী জাহাজসমূহ গতকাল দুপুর হতে বিকাল পর্যন্ত সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত ছিল।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ বাংলাদেশকে যে গড়ে তুলতে পারছি, বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্বে যে সম্মান আমরা পাচ্ছি, এখানে আপনাদের বিরাট অবদান রয়েছে। আপনাদের মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের কল্যাণার্থে যা যা করণীয় তা করে যাব।

শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকেই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যও সব রকম চেষ্টা চলছে।

বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দেশকে আরও উন্নত করার জন্য নানা ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যতটুকু সম্পদ আছে তা যথাযথভাবে কাজে লাগালে অবশ্যই আমরা সম্মানের সঙ্গে আমাদের দেশকে গড়ে তুলতে পারব।

যে বিদেশি বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তাদের সম্মানিত করার উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানান, প্রতি জেলা ও ৪২২টি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ৪৩টি জেলা ও ১৬১টি উপজেলায় কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে। এসব কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য ও প্রদর্শনী থাকবে। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে সমবেত হতে পারবেন। এগুলোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জাতি জানতে পারবে। ইতিহাস বিকৃতি করতে কেউ সাহস পাবে না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার সুমহান দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর ওপর ন্যস্ত। এ পবিত্র দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম, অবকাঠামো নির্মাণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন, ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিবিধ কল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে ‘বদ্ধপরিকর’ বলে জানান তিনি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আবু এসরার এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর