মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পরিচালকদের পকেটে ব্যাংকের মুনাফা

নিজস্ব প্রতিবেদক

পরিচালকদের পকেটে ব্যাংকের মুনাফা

আইন ভঙ্গ করে শেয়ারবাজারে অবৈধ ব্যবসা করছে এনসিসি ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালকরাই প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এনসিসিবি সিকিউরিটিজেরও পরিচালক। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইন ভঙ্গ করে নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যাংকের শেয়ার ব্যবসা। ব্যবসার মুনাফা শেয়ার গ্রাহকদের না দিয়ে নিজেরাই পকেটস্থ করছেন পরিচালকরা। প্রতিবছর ব্যাংকের প্রায় শত কোটি টাকা মুনাফা হলেও সাধারণ গ্রাহকরা পাচ্ছেন না। ব্যাংকের মূল মুনাফার সঙ্গে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা পুরোটাই ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন পরিচালকরা। বিএসইসি থেকে একাধিকবার এনসিসি ব্যাংকের পর্ষদকে এনসিসিবি সিকিউরিটিজের পর্ষদ থেকে পৃথক করার নির্দেশ দিলেও তারা তা করেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে তফসিলি ব্যাংকের ব্যবসার বিষয়ে ২০১০ সালে নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় ব্যাংকগুলোকে সরাসরি ব্রোকারেজ ব্যবসা ও মার্চেন্ট ব্যাংকিং থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। আলাদা সহযোগী প্রতিষ্ঠান Subsidiary Company গঠনের মাধ্যমে এসব ব্যবসা পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনার পর ব্যাংকগুলোর নিজেদের প্রতিষ্ঠান থেকে ব্রোকারেজ ব্যবসাকে আলাদা করে। এনসিসি ব্যাংক কর্তৃপক্ষও নির্দেশনা মেনে পৃথক সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান করে। তবে এর পরিচালনায় ব্যাংকের পরিচালকরাই বসে যান। বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে মূল প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ সদস্যদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ৫০ ভাগ পর্যন্ত থাকতে পারবেন এবং সম্পূর্ণ আলাদাভাবে পর্ষদ গঠন করতে হবে। কিন্তু এনসিসি ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি ওই কোম্পানির সব পর্ষদ সদস্যই মূল প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা। ব্যাংকটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য এনসিসিবি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড আইন পরিপালন না করেই ব্যবসা করছে। বর্তমানে এনসিসিবি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ব্যাংকের পরিচালক মো. আমিরুল ইসলাম। তিনি আবার মূল প্রতিষ্ঠানের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান। এর আগে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন আবু মহসিন। যিনি বর্তমানে এনসিসিবি সিকিউরিটিজের পরিচালক ও ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান। এ ছাড়া এনসিসিবি সিকিউরিটিজের পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন— মো. নূরুন নেওয়াজ, আবদুস সালাম, ইয়াকুব আলী, মো. আবুল বাশার, খায়রুল আলম চাকলাদার, আমজাদ ফেরদৌস চৌধুরী, আবু মহসিন, সোহেলা হোসেইন, মো. মঈনউদ্দিন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে আছেন মিজানুর রহমান। ২০১০ সালের আগে ব্যাংক সরাসরি বিনিয়োগ করতে পারত শেয়ারবাজারে। যে বিনিয়োগের মাধ্যমে বড় ধরনের জালিয়াতি ও শেয়ার কারসাজি হয়েছে বলে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে লাগাম টেনে নতুন নিয়ম জারি করে। এনসিসি ব্যাংকের পরিচালকরা ওই নিয়ম মানছেন না। ব্যাংকের মাধ্যমে না করে এখন নিজেদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার কারসাজি করছেন। নিজেদের নামে-বেনামে বিনিয়োগ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে সাধারণ শেয়ার গ্রাহকদের পর্ষদে ঢুকতে দিচ্ছেন না। সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ মুনাফা দেখানো হবে তা ব্যাংকের পর্ষদ নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হওয়ার হিসাব জালিয়াতি করতে সমস্যা হয় না। ফলে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের পুরো মুনাফা আত্মসাৎ করছেন ব্যাংকের পরিচালকরা। ব্যাংকটির পরিচালকদের এই অনিয়মের বিষয়ে বিএসইসি থেকে বার বার নোটিস দিলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বরং বিএসইসিতে পর্ষদ সদস্য হিসেবে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এরপর গত জানুয়ারি মাসে বিএসইসি থেকে এনসিসি ব্যাংককে শোকজ নোটিস দেওয়া হয়। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত বছর এনসিসি ব্যাংকের মোট মুনাফা হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। অথচ সাধারণ শেয়ার গ্রাহকদের ডিভিডেন্ড দিয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। তার আগের বছর প্রায় শত কোটি টাকা মুনাফা হলেও ডিভিডেন্ড দিয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। এর মধ্যে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা যোগ না করে পুরো অর্থ আত্মসাৎ করছেন পরিচালকরা। এনসিসিবি সিকিউরিটিজের সিইও মিজানুর রহমানকে ফোন দিলে তিনিও স্বীকার করেন পর্ষদ সদস্য সবাই ব্যাংকের। তারাই পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। এনসিসিবি সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলামকে বার বার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর