মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজস্ব আদায়ে নতুন কৌশল

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পর বাড়তি আয়ের স্বপ্ন দেখছে এনবিআর

রুহুল আমিন রাসেল

নিত্যনতুন কৌশলে রাজস্ব আয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রয়াস এগিয়ে নিতে সারা দেশের মাঠপর্যায়ে কাজ করছে রাজস্ব প্রশাসন। ফলে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন শেষে আরও বাড়তি রাজস্ব আয়ের স্বপ্ন দেখছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সরকারের কুশলী দিকনির্দেশনা ও কঠোর নজরদারিতে রাজস্ব প্রশাসনে ব্যাপক গতি এসেছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সবার সহযোগিতায় রাজস্ব আদায় কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। নতুন প্রজন্মের মেধা আর শক্তি দিয়ে দেশ ও দেশের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার শুধু উন্নয়নে কাজ করছে না, জাতীয় মেধার বিকাশেও কাজ করছে। তিনি বলেন, শুধু করদাতাকে সেবা নয়, দেশব্যাপী মাঠপর্যায়ের অফিসসমূহকে পূর্ণাঙ্গ, স্বয়ংসম্পূর্ণ, আধুনিক, শক্তিশালী, জবাবদিহি ও প্রযুক্তিনির্ভর বিভাগ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘রাজস্ব প্রশাসনের সব বিভাগ ও দফতরকে নিয়ে অটোমেশন কাজ চলছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে আয়কর, মূসক ও শুল্ক বিভাগের সেবা পৌঁছে যাবে করদাতার দোরগোড়ায়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের কোষাগারে রাজস্ব জমা দেবেন, তিনি নির্বিঘ্নে ও খুব সহজে জমা দিতে পারবেন। এ ছাড়া অনেক সেবা ও তথ্য আমাদের সব ওয়েবসাইট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব প্রশাসনে ইতিমধ্যে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।’ প্রসঙ্গত, সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান এনবিআর তিন ধরনের রাজস্ব আদায় করে। এগুলো হলো— আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আমদানি শুল্ক। এর বাইরে করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় করে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। চলতি অর্থবছর মোট ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। এ অর্থের মধ্যে সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান এনবিআর আদায় করবে ২ লাখ ৩ হাজার ২১২ কোটি টাকা। বাকি রাজস্ব আসবে এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে। অটোমেশন, কর অব্যাহতির পরিমাণ কমানো, কর প্রশাসনের বিস্তৃতি, করের আওতা ও ভিত্তি সম্প্রসারণ এবং চলমান সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করা হবে।

এদিকে সারা দেশের মাঠপর্যায়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়ন ও সেগুলোকে রাজস্ববান্ধব প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের জন্য কৌশল প্রণয়নসহ সংশ্লিষ্টদের সম্প্রতি পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। সর্বস্তরে রাজস্ববান্ধব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় কর্মকর্তাদের আন্তরিক প্রয়াস চালানোর এই নির্দেশনায় বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি দিন দিন বেগবান হওয়ায় আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট রাজস্ব সম্ভাবনা বাড়ছে। তবে মাঠপর্যায়ে যথেষ্ট প্রয়াস চালানো সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সব প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তিকে করের আওতায় আনা যায়নি। এখনো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বিরাজ করছে। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গতিশীলতা বজায় রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে যেসব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা আসবে তা নিরসনে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগের মাঠপর্যায়ের কমিশনার এবং মহাপরিচালকদের দেওয়া ওই নির্দেশনায় আরও বলা হয়, মাঠপর্যায়ের সব দফতরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কর রাজস্বের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করতে হবে। সব রাজস্ব কর্মকর্তার পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন ও মাসিক ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রেরণ করতে হবে এনবিআরে। এর সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি বা আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট কার্যক্রমকে গতিশীল করতে হবে। সে লক্ষ্যে ফেসবুক নিয়মিতভাবে সমৃদ্ধ (আপডেট) করতে হবে। বিশেষ করে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প, ট্যাক্স অনলাইন প্রকল্প এবং অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম কার্যক্রম সফল করতে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগের মহাপরিচালক ও কমিশনারদের মধ্যে মাসিক পর্যালোচনা সভা করতে হবে। এনবিআর জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে নয়টি ‘কৌশল’ ঠিক করেছে রাজস্ব প্রশাসন। এগুলো হলো— আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট অনুবিভাগের কমিশনারদের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের সব কার্যালয়কে বাজেটের কর প্রস্তাব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান; বাজেট বাস্তবায়নে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, চেম্বার ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন পর্যায়ের সব অংশীজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব গড়ার রূপরেখা প্রণয়ন; ‘রাজস্ব সংগ্রহে সব অংশীজনের ভূমিকা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ও সংলাপের সিদ্ধান্ত; আগামী বছর ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, পরামর্শমূলক সভা ও পরিকল্পনা তৈরি; রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম জোরদারে এনবিআর থেকে সব কমিশনারেটের কার্যক্রম ও কমিশনারদের পক্ষ থেকে অধীনস্থ কার্যালয়গুলোর কার্যক্রম মনিটর; প্রতি দুই মাস অন্তর রাজস্ব সংগ্রহের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ; রাজস্ব সংগ্রহে সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর দক্ষতা বাড়াতে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত দুটি প্রশিক্ষণ একাডেমির মান উন্নয়ন; সব পর্যায়ের করদাতা সেবার মান উন্নয়নসহ নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ প্রদান। তবে নিত্যনতুন কুশলী দিকনির্দেশনা ও কঠোর নজরদারির মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসনে সর্বোচ্চ সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে নীরব বিপ্লব ঘটেছে এনবিআরে। তথ্যমতে, প্রায় দুই দশক আগে এনবিআরের শুল্ক বিভাগের অটোমেশন প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা তখন আলোর মুখ দেখেনি। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ২০০৯ সালে গঠিত সরকার এই অটোমেশন প্রক্রিয়ায় গতি আনে। এরপর একে একে রাজস্ব প্রশাসনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে থাকে। শুল্ক কার্যক্রমের অটোমেশন প্রক্রিয়া অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন ছিল সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এরপর অনলাইনে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা ই-টিআইএন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অতীতে সারা দেশে রাজস্ব প্রশাসনের যে সেবা পেতে দফতরে দফতরে ঘুরে ক্লান্ত হতেন ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক করদাতার প্রতিনিধিরা, এখন তা মিলছে রাজস্ব বিভাগের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। করদাতাদের জন্য তথ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি কল সেন্টারও চালু করেছে এনবিআর। আর পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার কর অঞ্চল-১ চালু করেছে মোবাইলে করসেবা। সারা দেশের সব আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও শুল্ক বা কাস্টম হাউসের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও করদাতাদের জন্য বিভিন্ন সেবামূলক তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনলাইনে ভ্যাট চালান যাচাই-বাছাই কার্যক্রম সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত। সব মিলিয়ে রাজস্ব প্রশাসনের সঙ্গে করদাতাদের যোগাযোগে একটি সহজ পথ রচিত হয়েছে। ফলে এখন করদাতারা ঘরে বসেই অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের পাশাপাশি আয়কর পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছেন। জানা গেছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহায়তায় ট্যাক্স ক্যালকুলেটর-বিষয়ক একটি মোবাইল অ্যাপস তৈরি করছে এনবিআর। আগামী মাসের শুরুতেই এই মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে করদাতারা তাদের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ করে রাজস্ব পরিশোধের সুবিধা পাবেন। এ লক্ষ্যে ‘আয়কর বিভাগের স্ট্রেনদেনিং গভর্নেন্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের (এসজিএমপি)’ আওতায় সারা দেশে আয়কর বিভাগের ৬৪৯টি সার্কেল অফিসে কম্পিউটার-সামগ্রী প্রদান করেছে সরকার। এনবিআর জানিয়েছে, অনলাইনে আয়কর রিটার্ন (আয়কর বিবরণী) পূরণ ও দাখিলের পাশাপাশি করদাতারা ঘরে বসেই পাবেন আয়কর রিটার্ন ও প্রাপ্তি স্বীকারপত্র। এ ছাড়া ই-পেমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে যে-কেউ অনলাইনে কর প্রদান করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে ব্যাংক, চালান বা ক্যাশের মাধ্যমে জমা দিয়ে নম্বরটি অনলাইনে দিয়ে দিতে হবে। এজন্য সব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে এনবিআর। ফলে যে কোনো করদাতা যে কোনো ব্যাংকের অনলাইনে অ্যাকাউন্ট থেকে কর দিতে পারবেন। এর পাশাপাশি প্রচলিত পদ্ধতিতেও কর অফিসের সব সেবা পাবেন যে কোনো করদাতা। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট ইলেকট্রনিক করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা ই-টিআইএনধারী হলেন প্রায় ২৩ লাখ ১৫ হাজার। এনবিআরের টার্গেট চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নতুন ৩ লাখ করদাতা তৈরি। তবে দেশে বর্তমানে করদাতাদের মধ্যে ব্যক্তিশ্রেণি, বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রাতিষ্ঠানিক করদাতার সংখ্যা কত, এমনকি দেশে কতজন নারী, পুরুষ ও পেশাভিত্তিক করদাতা আছেন, সে তথ্য নেই।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর