মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নেপথ্যে শত কোটি টাকার টেন্ডারবাজি!

চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের রহস্যজনক মৃত্যু

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

নেপথ্যে শত কোটি টাকার টেন্ডারবাজি!

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আধিপত্য বিস্তার এবং শত কোটি টাকার টেন্ডারবাজি কেন্দ্র করে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ও চবি ছাত্রলীগের একাংশের নিয়ন্ত্রক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী। তার পরিবার ও অনুসারীদের দাবি, পরিকল্পিতভাবে দিয়াজকে খুন করে লাশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিহত দিয়াজ চবি ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক। তিনি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী ও চট্টগ্রাম গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুর এ আলম মিনা বলেন, ‘এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। আমরা লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্টের অপেক্ষা করছি। রিপোর্ট পাওয়ার পর বলা যাবে।’ দিয়াজের ছোট বোন সাঈদা সরওয়ার নিশা বলেন, ‘তারা আমার ভাইকে মেরে ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আমার ভাই আত্মহত্যা করার মতো মানুষ নন।’ মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের দাবি, ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পা খাটে বালিশের ওপর দাঁড় করানো ছিল ছিল। বিছানার চাদর ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিল সাজানো। গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করা ব্যক্তির জিহ্বা ও মুখ দিয়ে ফেনা বের হলেও দিয়াজের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। যে রুমে দিয়াজের লাশ পাওয়া যায়, তার পেছনের বারান্দার দরজা ছিল খোলা এবং বারান্দার পাশে একটি বাঁশের মই লাগানো ছিল। পুলিশ ধারণা করছে, দিয়াজকে খুনের পর ওই দরজা দিয়ে মই বেয়ে পালিয়ে যায় ‘খুনিরা’। দিয়াজের লাশের সুরতহাল করা হাটহাজারী ইউএনও এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফসানা বিলকিস বলেন, ‘দিয়াজের শরীরের তিন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। তার গলা ও হাতে আঘাতের চিহ্নগুলো রয়েছে।’

নেপথ্যে টেন্ডার ও আধিপত্য : চবিতে প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতাদের একজন দিয়াজ ইরফান চৌধুরী। চবিতে নিজস্ব গ্রুপের পাশাপাশি শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন দিয়াজ। সম্প্রতি চবির প্রায় শত কোটি টাকার উন্নয়ন টেন্ডার ঘিরে ছাত্রলীগের আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন দিয়াজ। তার প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন চবি ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা এবং ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির দুই প্রভাবশালী নেতা।

এ টেন্ডার ঘিরে দুই গ্রুপের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষও হয়। ৩০ অক্টোবর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই গ্রুপ।

ওইদিন ছাত্রলীগের সহসভাপতি তাইফুল হককে কুপিয়ে জখম করেন দিয়াজ অনুসারীরা। এ ঘটনার ৪ ঘণ্টা পর দিয়াজ ও তার তিন অনুসারী চবি ছাত্রলীগের দুই সহসভাপতি মো. মামুন ও মো. নাজিম এবং পাঠাগার সম্পাদক আবু বকরের বাসায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে ছাত্রলীগের অন্য অংশ। এরপর দুই গ্রুপের মধ্যে একাধিক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শত কোটি টাকার টেন্ডার কেন্দ্র করেই দিয়াজকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তারা এটি আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দিতে খুনের পর লাশ ঝুলিয়ে দেয়। ৩০ অক্টোবর যারা তার বাসায় হামলা করেছিল, তারাই তাকে হত্যা করেছে।’ তবে ছাত্রলীগের আরেক নেতা বলেন, ‘দিয়াজের সঙ্গে যে টেন্ডার নিয়ে বিরোধ হয় তা সমঝোতা হয় কিছুদিন আগে। এ সমঝোতার বিনিময়ে দিয়াজকে বড় অঙ্কের টাকাও দেয় ওই গ্রুপটি।’ ঘটনার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত হলে দিয়াজের মা জোবায়দা খানম চৌধুরী তাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘টেন্ডারের জন্য একজন সহকারী প্রক্টর (নাম উল্লেখ করে) এবং ছাত্রলীগ নেতারা আমার বুকের মানিককে কেড়ে নিল। তাদের যদি কোটি টাকার প্রয়োজন হয় আমাকে বললেই তো দিতাম। তারা আমার ছেলেকে খুন করল কেন? যারা আমার ঘরে হামলা করেছে, তারাই আমার ছেলেকে খুন করেছে। আমি এ খুনের বিচার চাই।’

অনুসারীদের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ : কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছেন তার অনুসারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। গতকাল চট্টগ্রাম নগরী ও হাটহাজারীর বিভিন্ন এলাকা অবরোধ করেন তারা। জানা যায়, গতকাল সকালে ক্যাম্পাসগামী শাটল ট্রেন হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ পৌঁছলে তা আটকে দেন দিয়াজ অনুসারীরা। একই সময় চট্টগ্রাম-রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের চবি ১ নম্বর গেট ও নন্দীরহাট এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান দিয়াজ অনুসারীরা। এ সময় তারা দিয়াজের খুনিদের গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি করেন। এর আগে নগরীর প্রবর্তক রোড এলাকায় সড়ক অবরোধ করা হয়। প্রসঙ্গত, রবিবার রাতে চবির ২ নম্বর গেটের একটি বাসা থেকে দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একে হত্যাকাণ্ড দাবি করে আসছেন তার পরিবার ও অনুসারীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর