বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনীতির নতুন স্বপ্ন

পদ্মা সেতু ও মংলা বন্দরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে আশার আলো

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনীতির নতুন স্বপ্ন

পদ্মা সেতু ও মংলা বন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনীতির নতুন দিগন্তের সূচনা হতে যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন শুধু মংলা বন্দরকে আগামীর চাপ সামলানোর উপযোগী করে তোলা এবং অনুষঙ্গ হিসেবে বিমানবন্দর, রেল যোগাযোগ ও পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থা যুক্ত করা। অনুষঙ্গগুলো যুক্ত হলেই পাল্টে যাবে দক্ষিণাঞ্চল তথা দেশের অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মা সেতু ও মংলা বন্দর ঘিরেই ভবিষ্যৎ খুলনা গড়ে উঠবে। জন্ম নেবে নতুন আরেক বাংলাদেশ; যা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মংলা বন্দর ঘিরেই একসময় ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। শিল্পনগরী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল খুলনা। অনেক পালাবদলের পর আবার সেই মংলা বন্দর ঘিরেই দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হতে যাচ্ছে খুলনা। ইকোনমিক জোন করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে এখানে। মংলা বন্দরকে করা হচ্ছে আধুনিক ব্যবহার উপযোগী। ভারত-নেপাল-ভুটান এ বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এতে খুলনা পরিণত হচ্ছে ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ একটা জায়গায়। পদ্মা সেতু, রেলপথ, মংলা বন্দর ঘিরে খুলনায় অর্থনৈতিক ঊর্ধ্বমুখী অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। অধ্যাপক কাদির বলেন, খুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে, তা মূলত পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হলে   ভারত, নেপাল ও ভুটান মংলা বন্দর ব্যবহার করবে। এর পাশাপাশি পায়রা বন্দর চালু হলে খুলনা ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে হারানো ‘লিংকেজ’টা পুনরুদ্ধার হবে।

নিকট অতীতেও মংলা বন্দরকে বলা হতো নিঝুমপুরী। সেই নীরবতা ভেঙে কচ্ছপ গতিতে হলেও গত সাত বছরে বন্দরটি এগিয়েছে। সম্প্রতি মংলা বন্দরের উন্নয়নে চীন সরকারের সঙ্গে চুক্তির ফলে বন্দরটি আমূল পাল্টে যাবে। বন্দরের প্রতিটি কাজে আসবে গতি। দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নসহ লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে। রাজস্ব বেড়ে যাবে বহুগুণ। এক কথায় দক্ষিণাঞ্চলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে নিকট ভবিষ্যতে।

জানা যায়, পদ্মা সেতু চালু হলে আপনাআপনিই মংলা বন্দরের ব্যবহার কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু সেই চাপ সামাল দিতে যে পরিমাণ উন্নয়ন প্রয়োজন তা অর্থাভাবে সম্ভব হচ্ছিল না। চীন সরকারের উন্নয়ন বিনিয়োগ বন্দরের সার্বিক কর্মকাণ্ডে গতি ফেরাবে।

মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল রিয়াজউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে সড়কপথে রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দরের স্থানটি দখল করবে মংলা। তখন এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি খরচ চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে অনেক কমে যাবে। সংগত কারণেই আমদানি-রপ্তানিকারকরা অর্থ সাশ্রয়ে মংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। একই সঙ্গে রেলপথ যুক্ত হলে পণ্য পরিবহনের খরচও অনেক কমে যাবে। তখনকার চাপ সামলানোর জন্যই নানামুখী প্রস্তুতি চলছে।

মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ‘ভিশন-২০২১’ সামনে রেখে মংলা বন্দরের উন্নয়নে সিনোম্যাক নামে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩ হাজার কোটি টাকার বৃহৎ প্রকল্পের এমইউ গত বছর স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ প্রকল্পে নতুন চারটি জেটি ও দুটি ইয়ার্ড নির্মাণ, বহুতলবিশিষ্ট মাল্টি স্টোরেজ কার পার্ক নির্মাণ, ১১টি সার্ভে ও টাগবোর্ড এবং কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, চার লেনের সড়ক উন্নয়নসহ আটটি কম্পোন্যান্ট রয়েছে। এই বৃহৎ প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। চীন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ফলে এই মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন প্রায় নিশ্চিত হয়েছে।

জানা যায়, বর্তমানে মংলা বন্দরের পাঁচটি জেটির কার্যক্ষমতার অর্ধেকই অব্যবহূত থাকছে। আগামী দিনের চাপের কথা চিন্তা করে জেটিগুলোর সম্পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বড় ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করতে বন্দরের বহির্নোঙরে থেকে জেটি পর্যন্ত ১৩১ কিলোমিটার পশুর চ্যানেলটির নাব্য (গভীরতা) বাড়াতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং চলছে। ইতিমধ্যে এই চ্যানেলের তিন ভাগের এক ভাগ ক্যাপিটাল ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ১১২ কোটি টাকা। বাকি দুই ভাগের ড্রেজিংয়ের জন্য ৪৩১ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায়। একই সঙ্গে চ্যানেলের প্রয়োজনীয় নাব্য ধরে রাখতে নিজস্ব দুটি মেইনটেন্যান্স (রক্ষণাবেক্ষণ) ড্রেজার মেশিন কেনা হয়েছে। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য কেনা ২২টি আধুনিক যন্ত্রপাতি চলতি বছরের শেষ নাগাদ হ্যান্ডলিং কাজে যুক্ত হবে। বিদেশি জাহাজের জ্বালানি সহজলভ্য করতে বন্দরেই নির্মাণ হচ্ছে বৃহদাকারের তেল ডিপো। বন্দরেই শুল্কায়ন ইউনিট স্থাপনের কাজ চলছে। জানা যায়, মংলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত উন্নত সড়কব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শুধু যাতায়াতে দীর্ঘ সময় ও অনিয়মিত ফেরি পারাপারের কারণে মংলা বন্দর রাজধানী থেকে অনেক দূরে রয়ে গেছে। ফলত রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুরের শিল্প ও বাণিজ্য সেক্টর তথা ট্রেডগুলো মংলা বন্দরের ওপর নির্ভর করতে পারেনি। সব সময়ই চট্টগ্রাম বন্দরকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে আসছে। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায়ই জাহাজজট হয়। বহির্নোঙরে ২৫ দিন অপেক্ষা করার উদাহরণ অনেক। এর পরও ব্যবহারকারীরা মংলা বন্দর ব্যবহারে উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু এবং রেলপথ বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে বাধ্য। কারণ, বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব সড়কপথে প্রায় ২৬৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকার সঙ্গে মংলার দূরত্ব হবে সড়কপথে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার; যা চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার কম। এতে পরিবহন খরচ ও সময় দুটিরই সাশ্রয় হবে। আর রেলপথে পণ্য পরিবহনের খরচ তো কম আছেই। মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল রিয়াজউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানি শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় একটি সমুদ্রবন্দর থাকা সত্ত্বেও একে আমরা ব্যবহার করিনি। একটি মাত্র বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিলাম। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকার এ বিষয়টিতে খুব গুরুত্ব দেয়। মংলা বন্দরও যে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এর উন্নয়নে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে প্রকল্পগুলোর কাজ এখন চলছে।’ মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান বলেন, চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়ন হলে অবকাঠামো উন্নয়নে মংলা বন্দর বিস্তর লাভবান হবে। এতে বন্দরের সক্ষমতা বহুগুণে বেড়ে যাবে। পাশাপাশি বন্দরে আমদানি-রপ্তানি, কার্গো-শিপ হ্যান্ডলিং বাড়লে এখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, মংলায় ইতিমধ্যে অনেক এলপিজি প্লান্ট, ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে মংলা বন্দরের ওপর চাপ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। কারণ, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের চেয়ে মংলা বন্দরের দূরত্ব ৯৫ কিলোমিটার কম। বিশেষ করে গার্মেন্টের একটা বড় অংশ মংলা বন্দর দিয়ে রপ্তানি হবে। পদ্মা সেতুতে রেলওয়ে থাকায় মংলা বন্দরের ব্যবহার আরও বাড়বে। ভবিষ্যতের এসব বিষয় চিন্তা করেই ৩ হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে; যা বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম বন্দরের মতোই হয়ে উঠবে মংলা বন্দর। খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, ‘আগামীর মধ্য আয়ের অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি তা অর্জনে খুলনা বড় ভূমিকা পালন করবে। তবে এ উন্নয়নের সব থেকে বড় বাধা জ্বালানি গ্যাস। জ্বালানি গ্যাসের সঙ্গে শিল্পায়ন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দক্ষিণাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ। তা এখন নির্মাণ হচ্ছে। বিমানবন্দর হচ্ছে। মংলা বন্দরের আধুনিকায়নের কাজও চলছে। একই সঙ্গে সড়কব্যবস্থাও আমূল পাল্টে যাচ্ছে। ফলে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে আগামী দিনে শিল্পায়নের অমিত সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। হাজারো বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের পথ খুলে যাবে। মংলা বন্দরে ইপিজেডে পড়ে থাকা বাণিজ্যিক প্লটেও গড়ে উঠবে নানা শিল্প কারখানা। চাপ কমবে ঢাকার ওপর। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা দূর হবে। এজন্য পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।’ খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনাময় জায়গা খুলনা-মংলা জোন। তিনি বলেন, বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলতে মংলা বন্দরকে এমন পর্যায়ে নিতে হবে যা ভারত-নেপাল-ভুটানের ব্যবহার উপযোগী হয়। একই সঙ্গে মংলা থেকে প্রস্তাবিত রেললাইনও যেন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা জরুরি।

 

সর্বশেষ খবর