বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কষ্ট আর প্রতারণার সব কথা শোনালেন সাঁওতালরা

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

রংপুর চিনিকলের আওতাধীন গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ, হত্যা ও হামলার ঘটনায় গতকাল সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর চার্চ প্রাঙ্গণে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আয়োজনে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হওয়া ঘণ্টাব্যাপী এ গণশুনানিতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন সাঁওতালরা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে সাবেক বিচারপতি শামছুল হুদা, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বায়েজিদ আব্বাস, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ, কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরীসহ ঢাকা থেকে ১০ সদস্যের একটি দল মাদারপুর পৌঁছায়। তাদের সঙ্গে রংপুর ও গাইবান্ধা থেকে যোগ দেন আরও আটজন। এই ১৮ সদস্যের দলটি সাঁওতাল পল্লী পরিদর্শন করে। পরে গণশুনানি পরিচালনা করেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শামছুল হুদা। শত শত সাঁওতালের উপস্থিতিতে শুনানিতে বারনা মুরমু, রাফায়েল হাসদা, রিনা মাইতি, কৃষ্ণ মুরমু, ববিতা মুরমু ও ভেরজুলিও হেমব্রম ১৯৫৫ সালে তাদের পূর্বপুরুষের ঘরবাড়ি ভেঙে ১ হাজার ৮৪২ একর জমি দখল প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এ সময় তারা জানান, তাদের বাপ-দাদাদের জমি চিনিকল যখন নিয়ে নেয় তখন শুধু জমিতে থাকা ফসলের মূল্য বাবদ টাকা দেওয়া হয়। জমির কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৬২ সালে জমি অধিগ্রহণের কাগজপত্র করা হয়। জমিতে চিনিকলের জন্য আখ ছাড়া অন্য কোনো ফসল চাষ করা হলে জমি মূল মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে সে সময় চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের কাছে সেই জমি লিজ দেওয়া হয়। যেখানে ধান, ভুট্টা, আলু, গম চাষাবাদ করা হতো। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ জমিতে নয়টি পুকুর খনন করে মাছ চাষ শুরু করেন বলেও তারা জানান। পরে এমপি আবুল কালাম আজাদ এবং সাপমারা ইউপি চেয়ারম্যান শাকিল আহম্মেদ বুলবুল এই জমির মালিকানা পেতে তাদের আন্দোলনে নামার ইন্ধন দেন। বুলবুল জমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি হয়ে প্রতি সপ্তাহে শনিবার সভা করে আন্দোলনের খরচ ও কাগজপত্রের কথা বলে দেড় থেকে দুইশ টাকা করে চাঁদা তোলেন। একসময় বুলবুল আন্দোলন থেকে সরে পড়েন। সাঁওতালরা বলেন, ৬ নভেম্বর দুপুরে কাটামোড় এলাকায় আখ কাটা নিয়ে সাঁওতালদের সঙ্গে মিল কর্মচারীদের বিরোধের পর বিকালে পরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর হামলা চালায় প্রশাসন। এ সময় পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি তাদের ওপর হামলা গুলি চালায় এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়। তাদের জমি ছাড়ার জন্য কোনো পূর্ব নোটিসও দেওয়া হয়নি বলে তারা অভিযোগ করেন। উচ্ছেদের পর এখন পর্যন্ত শত শত পরিবার খোলা আকাশের নিচে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে বলে তারা জানান। সাঁওতালদের দাবি, ১৯৪০ সালের রেকর্ড অনুযায়ী তাদের বাপ-দাদার জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। সাঁওতালরা গণশুনানিতে দাবি জানিয়ে বলেন, ঘটনায় জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বেআইনিভাবে উচ্ছেদে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে এর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। একই সঙ্গে তারা বলেন, সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি ছাড়া সরকারি কোনো খাসজমিতে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ তারা কখনই মেনে নেবেন না। শুনানি শেষে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, অধিগ্রহণ করা জমি অন্য কাউকে লিজ দেওয়ার অধিকার চিনিকল কর্তৃপক্ষের নেই। ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের প্রয়োজনে আমরা আইনগত সহায়তা দেব। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে পরিচালিত গণশুনানির রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট দফতরসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়ে আপনাদের দাবি উপস্থাপন করা হবে।’ গণশুনানি শেষে মাদারপুর চার্চ এলাকায় বিক্ষুব্ধ সাঁওতালরা মিছিল করেন। মিছিলটি ওই এলাকার পার্শ্ববর্তী সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে।

ধান কাটার সিদ্ধান্ত হয়নি : সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের যেসব জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, সেখানে নিজেদের রোপণ করা পাকা রোপা আমন ধান কাটার সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত করেনি সাঁওতালরা। তবে গতকাল দুপুরে জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম ও চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আউয়াল জমিগুলো পরিদর্শন করেছেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক জানান, পরিমাপ করে দেখা গেছে ৪৫.৫০ একর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ একর জমির ধান কাটার উপযোগী হয়েছে। বাকি জমির ধান কাটার উপযোগী হতে আট থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। জেলা প্রশাসক বলেন, হাইকোর্ট ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ধান কাটার নির্দেশ দিয়েছে। ওই আদেশের দুটি অংশ রয়েছে। একটি অংশে বলা হয়েছে ‘অধিগ্রহণকৃত জমিতে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী যে ধান চাষ করেছে, সে ধান সংগ্রহে তাদের সুযোগ দিতে হবে। অপরাংশে বলা হয়েছে, যদি প্রথমটি সম্ভব না হয় তাহলে সুগার মিল কর্তৃপক্ষ এ ধান সংগ্রহ করবে এবং সম্পৃক্ত সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কাছে তা হস্তান্তর করবে। নির্দেশনা অনুযায়ী সাঁওতালরা যদি ধান সংগ্রহ না করে তবে সুগার মিল কর্তৃপক্ষ ধান কেটে তাদের বুঝিয়ে দেবে।  সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম আদিবাসী ভূমি উদ্ধার কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে জানান, কমিটির নামে সংঘবদ্ধভাবে রোপা আমন ধান চাষ করা হয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ধান কাটা হবে। তবে ধান কাটার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। এ ছাড়া এখনো অনেক জমির ধান পাকতে বাকি আছে। ধান কাটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে মিল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে জানানো হবে।

সাঁওতালদের ওপর হামলায় রুল : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, গুলি ও হত্যা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। ওই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। একটি রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল দেয়। স্বরাষ্ট্র সচিব, শিল্প সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক, গাইবান্ধার পুলিশ সুপার, গোবিন্দগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং মহিমাগঞ্জ সুগার মিলের ম্যানেজারকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। সাঁওতালদের ওপর হামলার ঘটনা তদন্তে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে ২১ নভেম্বর এই রিট করা হয়। রিটের পক্ষে আইনজীবী রফিকুর রহমান ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু শুনানিতে অংশ নেন।

 

সর্বশেষ খবর