বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দফতর খুলে প্রতারণা দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে!

নিজস্ব প্রতিবেদক

দফতর খুলে প্রতারণা দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে!

রীতিমতো দফতর খুলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন রকমের সরকারি কাজ করছে একটি প্রতারক চক্র। ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ (কাবিখা), ‘টেস্ট রিলিফ’ (টিআর) ও জিআর প্রকল্প এবং ব্রিজ, কালভার্ট, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া ও নেওয়া হচ্ছে প্রতারকের এই নিজস্ব মন্ত্রণালয় থেকে। বিভিন্ন এলাকার সংসদ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের অজান্তে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্যাড ও স্বাক্ষর জাল করে এই দফতরে বানানো হচ্ছে চাহিদাপত্র। আশ্চর্যজনকভাবে সেসব চাহিদাপত্রের অনুকূলে সরকারি বরাদ্দও পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সরকারি চাল-গম গোডাউন থেকে খালাসও হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। পরে তা চলে যাচ্ছে খোলা বাজারে। এসবই হচ্ছে সচিবালয় থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে বিজয়নগরে একটি বহুতল ভবনে খোলা প্রতারকের বিকল্প এই মন্ত্রণালয়ে। জানতেই পারছেন না যাদের নামে বরাদ্দ সেই সব সংসদ সদস্য। কয়েক দফায় এ ধরনের ঘটনার পর জানতে পেরে একাধিক এমপি অভিযোগ করেছেন সংসদীয় কমিটিতে। তদন্তে নেমেছে দুদকও। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেছেন, কাবিখা, টিআর ও জিআর প্রকল্প এবং ব্রিজ, কালভার্ট, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে বিশেষ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিনব অপকৌশল দেখে কমিটি বিস্মিত। খোদ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের নামেও ভুয়া চাহিদাপত্র তৈরি করে বরাদ্দের অর্থ, গম ও ঢেউটিন নয়ছয়ে কমিটি ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। সচিবকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে কমিটি। প্রাপ্ত দলিলপত্রাদি অনুসারে, বেশ কিছু ভুয়া চাহিদাপত্রের অনুকূলে বরাদ্দ পেয়েছে প্রতারক ও দালাল সিন্ডিকেট। এর একটিতে গত ১৪ জানুয়ারি গাইবান্ধা-৪ আসনের এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের অফিশিয়াল প্যাডে ৩৫টি প্রকল্পের বিপরীতে বিশেষ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। ১৫ মার্চ এই প্রকল্পগুলোর অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। একই ধরনের ভুয়া প্রকল্পের চাহিদাপত্র তৈরি করা হয়েছে চট্টগ্রাম-১৬ আসনের এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর নাম ব্যবহার করে। একই ধরনের চাহিদাপত্র তৈরি করা হয়েছে ডেমরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চেয়ারম্যান, চাঁদপুরের মতলবের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিশিয়াল প্যাডে। এগুলোতে বরাদ্দও হয়েছে। সংসদীয় কমিটি ও দুদকে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, নিজেরা আত্মসাতের পাশাপাশি চক্রটি অনেক সময় বৈধভাবে আসা চাহিদাপত্রের বিপরীতেও প্রতি টন গম বরাদ্দের জন্য ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা কমিশন নিচ্ছে। একটি ব্রিজ বরাদ্দের বিপরীতে দুই থেকে ৪ লাখ টাকা, কালভার্টে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কমিশন নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থায়ী-অস্থায়ী নিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এবং জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা (ডিআরও) পদে বদলি বাণিজ্যেরও অভিযোগ এসেছে সংসদীয় কমিটিতে। অভিযোগ অনুসারে, ৪৩০ জন প্রকল্প সহকারী নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তি দেয়। অথচ চক্রটি এই পদে চাকরি দেওয়ার নামে ৫০০ লোকের কাছ থেকে অগ্রিম আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা করে নিয়েছে। এছাড়া আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কার্যসহকারী, ড্রাইভার, অফিস সহকারী ও পিয়নসহ বিভিন্ন পদে মন্ত্রণালয় ৩৮৬ জন লোক নিয়োগ দেবে। এসব পদের বিপরীতেও প্রায় ৫০০ জনের কাছ থেকে অগ্রিম কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্র। অভিযোগ পত্রে আরও উল্লেখ আছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ এই দুই অর্থবছরে টেন্ডারের মাধ্যমে তিন ধাপে প্রায় ৫০ কোটি টাকার কম্বল সরবরাহ নেয় ত্রাণ মন্ত্রণালয়। টেন্ডারে শুধু একই মালিকানাধীন পাঁচটি প্যাডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। একজনের নামে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠান এবং তার স্ত্রীর নামে খোলা ‘তালুকদার এ্যান্ড কোং’, দুই মেয়ের নামে ‘ঋত্তিকা এ্যান্ড সন্স’ এবং ‘প্রভাতী এ্যান্ড কোং’-এর মাধ্যমে অংশ নেয় টেন্ডারে। তার সিন্ডিকেটের দাপটে অন্য কেউ অংশ নিতে পারেনি টেন্ডারে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী প্রতিটি কম্বলের ওজন হওয়ার কথা ছিল ২ কেজি ৩০০ গ্রাম করে। কিন্তু বাস্তবে কোনোটির ওজন ১ কেজি, কোনোটি ১ কেজি ৩০০ থেকে ১ কেজি ৭০০ গ্রামের বেশি নয়। ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা বাজারমূল্যের এসব কম্বল সরকার প্রতিটি ৬০০ টাকা করে কিনেছে। সরবরাহকৃত কম্বল ব্যবহার অনুপযোগী ও নিম্নমানের হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে এসব কম্বল সরকারি ত্রাণ ভাণ্ডারে পড়ে আছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু জানান, অভিযোগগুলো সম্পর্কে গত মাসে সংসদীয় কমিটির একটি বৈঠকে উপস্থিত থাকা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। অনেক কথাবার্তার পর মন্ত্রী কমিটিকে বলেছেন, ‘মন্ত্রণালয় অভিযোগগুলো তদন্ত করবে। সত্যতা পাওয়া গেলে মন্ত্রণালয়ও ব্যবস্থা নেবে। সংসদীয় কমিটি বা যে কেউই খতিয়ে দেখতে পারে, এতে মন্ত্রণালয়ের আপত্তি নেই।’ পরে মন্ত্রণালয়ের সচিবকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কমিটি। সচিবের প্রতিবেদন সন্তোষজনক না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি।

সর্বশেষ খবর