শিরোনাম
শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রতারণা হায় হায় কোম্পানির

সাঈদুর রহমান রিমন

প্রতারণা হায় হায় কোম্পানির

ভুয়া এনজিও, এমএলএম ও ভুঁইফোড় কোম্পানিগুলোর প্রতারণা-জালিয়াতি থামছেই না। সাধারণ মানুষের আমানত লুটে নিয়ে রাতারাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে এসব ‘হায় হায় কোম্পানি’। এসব কোম্পানির কর্ণধাররা থাকছেন বহাল তবিয়তে, প্রতারণার ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রতারক চক্র বাধাহীনভাবে কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়ার পর পত্রপত্রিকায় হৈচৈ হলে তবেই সরকারি সংস্থাগুলো নড়েচড়ে ওঠে। কয়েক দিন নানা ভঙ্গিমায় তদন্ত চলে, একপর্যায়ে সবকিছুই চাপা পড়ে যায়। শুধু থামে না সর্বস্ব হারানো লোকজনের হাহাকার, কষ্টকান্না।

শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশজুড়েই গজিয়ে উঠছে বিভিন্ন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি। ২০০২ সালে দেশে এমএলএম কোম্পানি ছিল ১৬টি, ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪টিতে। বর্তমানে সরকারি হিসাবে ৬৯টি এমএলএম কোম্পানির অনুমোদন থাকার কথা বলা হলেও দেশে দুই শতাধিক এমএলএম কোম্পানি ‘কাজ’ করছে। এসব ছাড়াও ভারত, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান থেকে নতুন নতুন সংস্থা বাংলাদেশে আসছে। তারা মাল্টিপারপাস আদলের সার্টিফিকেট জোগাড় করেই প্রতারণার পসরা নিয়ে বসছে। কেউবা শুধু ট্রেড লাইসেন্স করেই ‘অলৌকিক পদ্ধতির’ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণয়ন করা হয় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ আইন। এ আইনের অধীন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা হয় বিধিমালা, যা আবার সংশোধন করা হয় ওই বছরের ২২ জুলাই। এ আইনে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আর লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা করা হয় রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসকে (আরজেএসসি)। আরজেএসসি থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য না দেওয়ার শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু লাইসেন্সের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি এড়িয়ে প্রতারক চক্র কেবল জয়েন্ট স্টকের অনুমোদন আর নামের ছাড়পত্র নিয়েই প্রতারণার বাণিজ্য খুলে বসে। সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশনের অনুমোদন নেওয়ার সময় তারা ‘ক্যাটাগরি’ কলামে ব্যবসার ধরন হিসেবে আমদানি-রপ্তানি, হারবাল পণ্য উৎপাদন, বিক্রি, আইটি সফটওয়্যার, বহুমুখী পণ্য বিপণন, ট্রাভেল এজেন্সি, বৃক্ষে বিনিয়োগ, অদৃশ্য স্বর্ণ ব্যবসা, সর্বরোগমুক্তির ব্রেসলেট বিপণন ইত্যাদি উল্লেখ কনে। এদের বেশির ভাগেরই বৈধ অনুমোদন নেই, অফিস নেই; দেশে প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্য, রীতিনীতির সঙ্গেও কোনো মিল নেই। আছে শুধু অলীক স্বপ্ন আর চাপাবাজি।

বিভিন্ন নামে দুই শতাধিক এমএলএম কোম্পানি থাকলেও আইন পাসের পর দেখা যায় লাইসেন্সের জন্য আবেদন আবেদন করেছিল মাত্র ১৬টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে : দি ক্লাসিক লাইফ বিডি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, দেইসান বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড, এসএমএন গ্লোবাল লিমিটেড, অ্যাডভান্স বাংলাদেশ লিমিটেড, টিয়ানসি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, ড্রিম টুগেদার লিমিটেড, এমএক্সএন মডার্ন হারবাল ফুড লিমিটেড, এবি নিউট্রিক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, লাইফওয়ে লিমিটেড, রিচ বিজনেস লিমিটেড, লাকজার গ্লোবাল অ্যান্ড লিমিটেড, এমওয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ফরএভার লিভিং প্রোডাক্টস বাংলা লিমিটেড, মেকনোম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মিশন-১০ লিমিটেড ও পিনাকল সোর্সিং লিমিটেড। সরকারের অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এরা। অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সদস্য বানাচ্ছে সহজ-সরল তরুণ-তরুণীদের। এর মাধ্যমে নিম্নমানের ইলেকট্রনিক-সামগ্রী ৩-৪ গুণ বেশি দামে সদস্যদের ধরিয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা। আর ভবিষ্যৎ আয়ের আশায় তাদের সেই পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন বেকারত্বের অভিশাপে ভুগতে থাকা তরুণ-তরুণীরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, এমএলএম কোম্পানি খুলে ব্যবসা করার জন্য সরকার নতুন করে কাউকে অনুমোদন দিচ্ছে না। এমনকি ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়। এগুলো হচ্ছে : মডার্ন হারবাল কোম্পানি লিমিটেড, স্বাধীন অনলাইন কোম্পানি লিমিটেড, ওয়ার্ল্ড ভিশন-২১ কোম্পানি লিমিটেড এবং মালয়েশিয়া ও চট্টগ্রামভিত্তিক একটি করে কোম্পানি। কিন্তু অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স না পেলেও দেশজুড়ে এমএলএমের প্রতারণা বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুমোদনের শর্তে বলা ছিল : প্রতি আর্থিক বছরে তাদের কার্যক্রম মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। একই সঙ্গে নতুনভাবে অনুমোদন (নবায়ন) নিতে হবে। ইতিমধ্যে ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরের বাজেট সংসদে পাস হয়েছে। কিন্তু অনুমোদিত কোম্পানিগুলো তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় মনে করছে, দেশে এমএলএম কোম্পানির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায়িত্ব শেষ! : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা, ক্রেতা পরিবেশক ও ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন- ২০১৩ প্রণয়ন করে। একই উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে এ আইনের বিধিমালারও সংশোধন করা হয়। এতে বলা হয় : এ আইন অনুসারে এমএলএমবিষয়ক লাইসেন্সবিহীন ব্যবসা পরিচালনা বা লাইসেন্স গ্রহণের পর সরকারের অনুমোদনবিহীন লাইসেন্স হস্তান্তর করা বা পিরামিডসদৃশ বিপণন চালানো বা বিপণন বা প্রতিশ্রুত পণ্য ও সেবা না দিয়ে অযৌক্তিকভাবে মূল্য নির্ধারণ; নিম্নমানের পণ্য-সেবার অসত্য, কাল্পনিক, বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ আইনের অপরাধসমূহ আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য। এ আইন অমান্য করে কেউ এমএলএম কার্যক্রম পরিচালনা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্থাপিত অভিযোগ অনুযায়ী অধিকাংশ এমএলএম কোম্পানি অবৈধ ব্যাংকিং ও হুন্ডির কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ থেকে বিরত থাকার জন্য মাঝেমধ্যে সতর্ক বিজ্ঞাপনও প্রচার করে ব্যাংক। কিন্তু হুন্ডির অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নজির দেখতে পায় না দেশবাসী।

‘এমএলএম বাণিজ্যের লাইসেন্স নেই’ : বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির নামে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেই। হাইকোর্টে রিট করে যেসব কোম্পানি প্রতারণার ফাঁদ পেতে নিরীহ মানুষ ঠকাচ্ছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এ সময় তিনি সাধারণ মানুষকে এমএলএম ব্যবসার ফাঁদ থেকে নিজেদের দূরে রাখার পরামর্শ দেন। দশম সংসদের দ্বিতীয় বাজেট অধিবেশনে সোমবার ৩০০ বিধিতে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে (আরজেএসসি) ২৭টি এমএলএম কোম্পানি আবেদন করে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের শুনানি গ্রহণ করে। ওইসব কোম্পানির পণ্য প্রকৃত মূল্যে বিনিময় না হওয়া এবং মোড়কের মান ঠিক না থাকায় এমএলএম কোম্পানি আইনের ৬ ধারায় লাইসেন্স বাতিল করা হয়। এরপর ওইসব কোম্পানি হাইকোর্টে রিট করে ব্যবসা পরিচালনা করছে। তিনি আরও বলেন, যেখানে মন্ত্রণালয় আপিল খারিজ করে দিল, সেখানে হাইকোর্টে রিট করে ব্যবসা করা হচ্ছে। এর আগে ডেসটিনিসহ বেশকিছু কোম্পানি সাধারণ মানুষকে পথের ভিখারি করেছে। এখন হাইকোর্টের রিটের সুবিধা নিয়ে নিরীহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ওইসব কোম্পানির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য সব বিভাগীয় কমিশনার বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।

ডেসটিনি-যুবকের অবস্থা : বছরের পর বছর ধরে ডেসটিনির গ্রাহকরা আশায় বুক বেঁধে আছেন। অথচ এক টাকাও ফেরত পাননি তারা। সরেজমিন দেখা গেছে, বেহাত হচ্ছে সম্পত্তি। কোনো কোনো কারখানার যন্ত্রপাতি অকেজো পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। অন্যান্য সহায়সম্পদও বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে, অনেক সম্পদ রয়েছে জবরদখলকারীদের কব্জায়। পার্বত্য এলাকায় কোম্পানির অধীনে থাকা গাছ চুরি হচ্ছে হামেশা। বিভিন্ন ব্যাংকে ডেসটিনি গ্রুপের ৫৩৩টি ব্যাংক হিসাবও জব্দ অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় প্রায় ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীর ভাগ্য অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ডেসটিনির বিষয়টি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। বিচার শেষে যে রায় হবে, তা-ই বাস্তবায়ন হবে। প্রতারণার দায়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) কার্যক্রম। যুবকের প্রতারিত গ্রাহক তিন লক্ষাধিক। যুবকের কার্যক্রম বন্ধের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকদের অর্থ দেওয়ার কোনো উপায় বের করতে পারেনি সরকার। সাবেক যুগ্ম-সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে সরকারের গঠিত ‘যুবক কমিশন’ ২০১৩ সালে যুবকের সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের সুপারিশ করে। এরপর একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হলেও কোনো উপায় বের হয়নি। একইভাবে ইউনিপেটুইউ, ইউনিগেটটুইউসহ অন্তত ২০টি এমএলএম কোম্পানি সাধারণ মানুষের ৭০ হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় কমবেশি চার কোটি মানুষ। কিন্তু সরকারি নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত প্রতারিত কোনো ব্যক্তিকে টাকা ফেরত দেওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর