শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শিক্ষকরাই প্রশ্নবিদ্ধ সৃজনশীল প্রশ্নে

আকতারুজ্জামান

শিক্ষকরাই প্রশ্নবিদ্ধ সৃজনশীল প্রশ্নে

শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে, গতানুগতিক মুখস্থবিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে ২০০৮ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। বলা হয়েছিল, সৃজনশীল প্রশ্নের গঠন কাঠামো শিক্ষার্থীর পরীক্ষা-ভীতি দূর করবে। কিন্তু সৃজনশীল নিয়ে খোদ শিক্ষকদেরই ভীতি কাটেনি। শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান করতে গিয়ে শেখাতে পারছেন না ছাত্রছাত্রীকে। প্রশ্ন তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেরা প্রশ্ন করতে না পেরে বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করছেন। আবার কোনো কোনো শিক্ষক গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে নিচ্ছেন সৃজনশীলের পরীক্ষা। সদ্য জেএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের সৃজনশীল প্রশ্ন হুবহু গাইড বই থেকে কপি করে পরীক্ষা নেওয়ার প্রমাণ মেলে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবে, অযোগ্যতায় মাঠেই মারা যাচ্ছে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি। ভেস্তে যাচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্য। শিক্ষকদের এ পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দেওয়ায় সৃজনশীল চালু হওয়ার আট বছর পরও এই পদ্ধতি চলছে জোড়াতালি দিয়েই। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির উপযোগিতা আছে কী না তা ভেবে দেখতে হবে। এ পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে না। পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়েও সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এটা অবান্তর। আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত শিক্ষক সরবরাহ করতে পারছি না। বিভিন্ন কারণে অনুপযুক্তরা শিক্ষক হচ্ছেন। তারা শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও পাচ্ছেন না। ইমেরিটাস এ অধ্যাপক বলেন, ‘শিক্ষকরাই সৃজনশীল পদ্ধতি ভালোভাবে বুঝতে পারেন না। তারা ছাত্রদের বোঝাবেন কী করে’? শিক্ষকরা সৃজনশীলের প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারছেন না। গাইডে নির্ভরশীল হচ্ছেন। ‘এই  সৃজনশীল পদ্ধতির তাৎপর্য কী আমি তা বুঝি না।’ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) সর্বশেষ ‘একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদন’-এ দেখা গেছে অর্ধেকের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেরা সৃজনশীলের প্রশ্ন প্রণয়ন করছে না। দেশে ১৮ হাজার ৫৯৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মে মাসে ৯টি শিক্ষা প্রশাসনিক অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৪২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সুপারভিশন করে এ প্রতিবেদন করা হয়েছে।  প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে বরিশাল। এ অঞ্চলের ৫৪৩টি বিদ্যালয়ে দেখা গেছে ৪৯৯টি বিদ্যালয়ই বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেছে। ১৭টি স্কুল অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন প্রণয়ন করেছে। মাত্র ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীলের প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। সৃজনশীলের প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। ৯২০টি স্কুলে সুপারভিশন করে দেখা গেছে, ৭৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্ন প্রণয়ন করেছেন। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকা অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন প্রণয়ন করে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুল, বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে ৯ দশমিক ২২ শতাংশ। ময়মনসিংহ অঞ্চলে অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন প্রণয়ন করে ৩৫ দশমিক ২০ শতাংশ, বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা, কুমিল্লা অঞ্চলের স্কুলগুলোতে দেখা গেছে যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ৩০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ৩৩ দশমিক ২৬ শতাংশ, ৩১ দশমিক ৭২ শতাংশ, ৩১ দশমিক ৯২ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুল অন্য স্কুলের সহায়তায় সৃজনশীলের প্রশ্ন সংগ্রহ করে। গত বছর নভেম্বরে মাউশির প্রস্তুতকৃত একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদন অনুযায়ী বরিশাল অঞ্চলের ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সৃজনশীলে প্রশ্ন বাইরে থেকে সংগ্রহ করেছে। বাইরে থেকে সবচেয়ে কম প্রশ্ন কিনেছিল সিলেটের প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাইরের প্রশ্ন সংগ্রহ করেছিল। ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হার ছিল যথাক্রমে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ১৫ দশমিক ১৪, ৩৪ দশমিক ৪, ১৭ দশমিক ৮৪, ৯ দশমিক ৯৩, ৩৯ দশমিক ১৫ ও ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মে মাসে একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, শিক্ষকরা যাতে সৃজনশীলে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন সে ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণসহ বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র যাতে সংগ্রহ করতে না পারে সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। মাউশি কর্মকর্তারা বলেছেন, উপজেলা, জেলা ও অঞ্চল পর্যায়ে প্রায় ২ হাজার কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা প্রতি মাসেই মাঠের তথ্যসংগ্রহ করে মাউশিতে পাঠান। সৃজনশীলে দক্ষ ও অদক্ষ শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হার প্রতি মাসেই ওঠানামা করে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করা হলেও এর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান এর আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সৃজনশীলে শিক্ষকরা দক্ষ নন এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই। সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক শিক্ষকের ধারণাই নেই। তিনি বলেন, সরকার কিছু শিক্ষকের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এ সংখ্যা নগণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম গবেষক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, সৃজনশীলের ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ছাড়া অনেক শিক্ষকের যোগ্যতারও অভাব রয়েছে। যার কারণে সরকারের বিভিন্ন প্রশিক্ষণেও তারা প্রশিক্ষিত হতে পারছেন না। প্রশ্ন তৈরির জন্য শিক্ষকদের সাপোর্ট সিস্টেমের অভাব রয়েছে। এ কারণেই শিক্ষকরা নোট বা গাইড বইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

সর্বশেষ খবর